Logo
Logo
×

জাতীয়

ঈদে গ্রামে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

Icon

জাহিদ হাসান 

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৩, ১০:৪৫ এএম

ঈদে গ্রামে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকা ছেড়ে মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে যাবে। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে কমবেশি জ্বরে ভুগলেও তা ডেঙ্গি ভাইরাসজনিত কি না নির্ণয় করা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গি আক্রান্তরা গ্রামে গেলে তাদের মাধ্যমে অন্যরাও সংক্রমিত হতে পারে। ফলে ঈদের দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে বলে রোগতত্ত্ববিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

মঙ্গলবার শেষ হওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাকবর্ষা মৌসুমের মশা জরিপের তথ্য বলছে, ঢাকায় বসতবাড়িতে গত বছরের তুলনায় এবার এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। ১৮ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। গত চার-পাঁচ বছরে এত বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি এবার ডেঙ্গির ডেন-২ ধরনও বেশি দেখা যাচ্ছে। ডেন-২-এর পরিমাণ বেশি হলে এবং মানুষ দ্বিতীয়বার ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ইকরামুল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রাকবর্ষা উপলক্ষ্যে দুই সিটির মোট ৩ হাজার ১৫০ বাড়িতে জরিপ মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ বাড়ির মধ্যে ৪০০ বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। 

অর্থাৎ প্রায় ১৮ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। বেশি লার্ভা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ তাপমাত্রা বৃদ্ধি; বৃষ্টিপাতের ধরন পালটে যাওয়া; ঢাকায় নিয়মিত ভবন নির্মাণে-এডিসের লার্ভা জন্মের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং মানবসৃষ্ট সমস্যায় এডিসের লার্ভার বেশি জন্ম হচ্ছে।

ইকরামুল হক বলেন, ২০১৭ সাল থেকে তিনি জরিপ নিয়ে কাজ করছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বর্ষা মৌসুমের জরিপে রাজধানীর ১২ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এবার ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটিতেই ১৮ শতাংশ বাড়িতে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় ডেঙ্গি আক্রান্ত ব্যক্তি গ্রামে যাওয়ার পর তাকে কোনো সাধারণ মশা কামড়ালে ক্ষুদ্র প্রাণীটির দেহে এডিসের জীবাণু প্রবেশ করবে। এরপর মশাটি আরেকজন মানুষকে কামড়ালে তিনিও ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হবেন। ঈদ ঘিরে সারা দেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ডেঙ্গি রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, এবার ঢাকা শহরের নির্মাণাধীন ৬০ শতাংশ ভবনে এডিস মশা পাওয়া গেছে। ওয়াসার পানির মিটার, বহুতল ভবনের বেজমেন্টসহ ফেলে রাখা পাত্রে জমা পানিতে লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। প্রাক মৌসুমেই এ পরিস্থিতি হলে বর্ষাকালে ডেঙ্গি পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। ঈদ ঘিরে এডিস মশা ও ডেঙ্গি ভাইরাসের ট্রান্সমিশনের ফলে আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর সব জেলায় ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়বে। ঢাকাতে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছতে পারে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গি এখন রাজধানীকেন্দ্রিক নয়। বরং সারা দেশে ছড়াচ্ছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় সংক্রমণ ঝুঁকিও বাড়ছে। ঈদ উদযাপনে যারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন-তারা ডেঙ্গি নিয়ে যেতে পারেন অথবা গ্রামে গিয়েও ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। শুরুতে ইনকিউবেশন পিরিয়ড হওয়ায় অনেকের প্রাথমিক পর্যায়ের লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। ফলে গ্রামে যাওয়ার পর জ্বর ছাড়াও সর্দি-কাশিজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জা, ফ্লু ভাইরাস দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্র যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে পরীক্ষা ও ওষুধ খেতে হবে।

রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশেই ডেঙ্গি মশা আছে, যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে। যে যেখানেই যান, মশার কামড় খাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে মানুষের সঙ্গে যানবাহনেও প্রচুর ডেঙ্গি মশা গ্রামাঞ্চলে চলে যাবে। প্রায় সময় বৃষ্টিতে যত্রতত্র পরিষ্কার পানি জমে থাকছে। যেখানে মশা ডিম ফুটানোর সহায়ক পরিবেশ পাচ্ছে। ডেঙ্গিবাহিত মশা যেখানে ডিম পারে সেই ডিমে এক বছর পর্যন্ত ভাইরাস সক্রিয় থাকে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে ‘ওভারিয়ান ট্রান্সমিশন’ বলা হয়। সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। 

জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে বেশ কয়েক মাস আগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক ও জনস্বাস্থ্যবিদরা সতর্ক করেছেন। এ সত্ত্বেও ডেঙ্গি প্রতিরোধের জন্য সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। মফস্বলের হাসপাতালগুলো ক্রিটিক্যাল ডেঙ্গি রোগীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ততটা প্রস্তুত নয়। 

ঢাকাসহ বড় বড় শহরের হাসপাতালগুলোয় যেভাবে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থাকেন, ঈদে সেভাবে গ্রামের হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক পাওয়া যাবে না। ৮৬ হাজার গ্রামে পরিস্থিতি অনেকটা একই রকম। তাই এডিস মশা ও ডেঙ্গি মোকাবিলায় এখনই সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর মশক নিধনকারী ওষুধ ছিটানোর বা স্প্রে করার ব্যবস্থা করতে হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা জানিয়েছে, বিগত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গি আক্রান্ত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অধিদপ্তর থেকে হাসপাতালগুলোকে ১১টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ডেঙ্গি স্ক্রিনিংয়ের পর্যাপ্ত কিটের ব্যবস্থা করা, প্রাদুর্ভাব বেশি বেড়ে গেলে আবাসিক চিকিৎসক ও আরএমও’র কক্ষে অতিরিক্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেওয়া। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গি রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত মশারির ব্যবস্থা করা। 

আরও দুজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১৪৫ : এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৪৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ৪১০ ডেঙ্গি রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ১১ জন ও ঢাকার বাইরে ৩৯৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গিতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে মোট ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম