দাবদাহে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুরা, ঘরে থাকার পরামর্শ
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ১০:৫০ পিএম
![দাবদাহে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুরা, ঘরে থাকার পরামর্শ](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/06/06/image-683091-1686070535.jpg)
প্রচণ্ড দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হওয়ার উপক্রম। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, কয়েকটি জেলার উপর দিয়ে তীব্র এবং বেশিরভাগ অঞ্চলে মাঝারি ও মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। যা আরও সপ্তাহখানেক থাকতে পারে। এদিকে প্রচণ্ড গরমে গর্ভবতী নারী, নবজাতক-শিশু, প্রবীণ ও শ্রমজীবীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এরমধ্যে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের ভোগান্তি বেড়েছে বহুগুণ। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে শিশু ও গর্ভবতীদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়াবিদরা জানান, সাধারণত দেশে এপ্রিল ও মে মাসে বেশি গরম পড়ে। চলতি বছরের এই দুই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। গেল মে মাসের শুরুতে তীব্র গরম পড়েছিল। গত ১৪ মে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় মোখা সৃষ্টির ফলে গরম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু মাসের শেষ দিকে ফের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এবার মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪ ভাগ বৃষ্টি কম হয়েছে। চলতি জুনেও কম বৃষ্টি হতে পারে। বর্তমানে প্রকৃতিতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকছে। আগামী এক সপ্তাহ দেশের ওপর দিয়ে মৃদু, মাঝারি এবং তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে জানান, দেশব্যাপী চলমান মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু ও গর্ভবতীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ গরমে শরীর থেকে ঘাম বের হয়ে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়। এতে হৃৎপিণ্ড ও নাড়ির গতি বেড়ে যায়। মাথা ঘোরা বা বমিভাব দেখা দেয়। হিট স্ট্রোকে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। তাই গর্ভবতী নারী, নবজাতক ও শিশুদের গরমজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে।
মঙ্গলবার শ্যামলী এলাকা থেকে মোহাম্মাদপুর মা ও শিশু হাসপাতালে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে তৃতীয়বারের মতো ফলোআপে নিয়ে আসেন রায়হানা বেগম। হাসপাতালের দীর্ঘ লাইনে মায়ের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে এক সময় পাশে রাখা বেঞ্চে বসে পড়েন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে রায়হানা বেগম বলেন, কয়েকদিন অতিরিক্ত গরমে মেয়ের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। আজ রোদের মধ্যে হাসপাতালে আসার সময় আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। অসহনীয় গরমজনিত অসুস্থতায় মেয়ে ও তার পেটের বাচ্চাকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তারা।
এদিন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের বহিঃ ও জরুরি বিভাগের সামনেও শিশু রোগীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ শিশুই তাপপ্রবাহজনিত কারণে অসুস্থ হয়েছে। হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রচণ্ড গরমে শিশুদের জ্বর, সর্দি, পেটব্যথা, বমি ও পাতলা পায়খানার মতো রোগ হচ্ছে। নবজাতক থেকে শুরু করে অনেকে শিশু ঠান্ডা-কাশি, শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে আগের চেয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. আরিফা শারমিন বলেন, গর্ভবতী নারীরা শরীরে একটু বেশি গরম অনুভব করেন। বর্তমানে অতিরিক্ত তাপমাত্রা তাদের কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গর্ভকালে মেটাবলিজম বেশি হওয়ায় ডিহাইড্রেশন বা শরীরে পানিশূন্যতা বেশি হয়। এতে পেটের বাচ্চা যে ফ্লুইডের মধ্যে থাকে সেটির পরিমাণ কমে যেতে পারে। বাচ্চার ফ্লুইড ও নিউট্রিশন সংকটে স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চরক্তচাপ আছে এমন গর্ভবতীদের অতিরিক্ত গরমে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। প্রি একলামশিয়া বা খিঁচুনি হতে পারে।
তিনি বলেন, গর্ভবতীরা উচ্চ তাপমাত্রার প্রতি স্পর্শকাতর। এটা গর্ভের সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এছাড়া তীব্র গরমে অজ্ঞান বা মূর্ছা যাওয়া, বমি, শরীরে পানিশূন্যতা, এমনকি হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখে দিতে পারে। ফিটাস বা পেটের বাচ্চার ওজন কমে যেতে পারে। কিছুক্ষেত্রে নবজাতকের জš§গতত্র“টি ও প্রিটার্ম লেবার অর্থাৎ সময়ের আগেই ডেলিভারি হতে পারে। গরমকালে প্রসূতির ইউরিন ইনফেকশন হয়ে পেটে ব্যথা ও ইউরিনের জ্বালা হতে পারে। অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য ও ত্বকে চুলকানি হতে পারে।
এদিকে শিশু শিক্ষার্থীদের তাপপ্রবাহজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে ৮ জুন পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।
ঢাক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, তীব্র গরমে সব বয়সিরাই অতিষ্ঠ। এমন আবহাওয়া শিশুদের জন্য বেশ কষ্টকর। এখন যারা জরুরি ও বহিঃবিভাগে আসছে তাদের অধিকাংশেরই অতিরিক্ত ঘেমে পানিশূন্যতা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া ও দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। গরম আবহাওয়ায় জ্বর, বমি ও ডায়রিয়া সমস্যা নিয়েও শিশু রোগী আসছে। তাই এ সময় শিশুর যতেœ বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়াই ভালো।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, দেশে ডেঙ্গির সংক্রমণ চলছে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড গরম পড়ছে। দাবদাহে কিছু ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মামস, জলবসন্ত, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। বয়স্ক, শিশু এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন-গর্ভবতীদের মধ্যে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ সময় শিশুদের মধ্যে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ থেকে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ইতোমধ্যেই দেশে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এ সময় শিশুদের ঘরের বাইরে যাওয়া, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ও বরফ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।