প্রাথমিকে প্রযুক্তি ব্যবহার: উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহ বেড়েছে মেয়েদের
ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ০১:৫৯ পিএম
ট্যাব ডিভাইসের মাধ্যমে শিশুদের ইংরেজি শেখাচ্ছেন ক্লাস শিক্ষক। শিশুরা ক্লাস উপভোগ করছে এবং চেষ্টা করছে শিক্ষকের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার রতিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। শিশুদের এমন প্রচেষ্টা দেখে তাদের অভিভাবকরাও খুশি। নিয়মিত এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার হলে তাদের শিশুরা পড়াশোনায় আরও ভালো করবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া (ছদ্মনাম) যুগান্তরকে বলেন, আমি আগে পড়াশোনা ভালোভাবে বুঝতাম না, কিন্তু এখন ভালো করে বুঝি। কারণ আমাদের যে ট্যাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোতে ইংরেজি ও বাংলার অধ্যায়গুলো ছড়া আকারে রয়েছে, যা সহজেই মুখস্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া সহজভাবে দেওয়া আছে গণিতও।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মাইশা আক্তার (ছদ্মনাম) জানায়, তারা বিভিন্ন ধরনের কুইজ পরীক্ষায় অংশ নেয়। তারা ট্যাবের মাধ্যমে এ ধরনের পরীক্ষা দিতে চায়। কাগজে প্রশ্ন তৈরি ও প্রিন্ট করতে সময় লাগে। কিন্তু ট্যাব ডিভাইসে পরীক্ষায় সময় লাগে না। তাই ট্যাবে খুব আনন্দের সঙ্গে পরীক্ষা দিতে পারছে বলে জানায় সে।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিকভাবে অভিভাবকরা সচেতন ছিলেন না। তারা ভেবেছিল ট্যাব দিলে ক্লাসে তাদের সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাবে। তাদের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন সাইট বা খারাপ জিনিস দেখতে চাইবে। তাই তারা প্রথমে এগিয়ে আসেনি। পরে অভিভাবকদের এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া হয়। ট্যাবে অপ্রয়োজনীয় সাইট বন্ধ থাকায় শিশুরা অ্যাপ লগ ইন করে পড়াশোনা করতে পারছে। এভাবে পড়াশোনায় ভালো ফল পাওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।
এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাপলা সরকার জানান, ট্যাবের বিষয়বস্তু বিভিন্নভাবে করা হয়েছে। ভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে ই-কনটেন্টগুলো। কার্টুন আকারে ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট বানানো হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়কে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শিশুরা সহজে বুঝতে পারে। পাশাপাশি লক্ষ করা গেছে যে তাদের মধ্যে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কম। এতে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটছে। এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি প্রযুক্তির সহায়তায় পড়ালেখার গতি বেড়েছে শিশুদের মধ্যে।
একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. একরামুল হক চৌধুরী বলেন, প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে ট্যাব দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুগুলো ভালোভাবে সেখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। পড়ালেখার আগ্রহ বাড়ায় শ্রেণিকক্ষে শিশুদের উপস্থিতিও বেড়েছে। এসব ট্যাব দিয়ে সহযোগিতা করেছে একটি এনজিও সংস্থা।
মূলত এই বিদ্যালয়ের মতো উপজেলার ৬০টি বিদ্যালয়ে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির ছাত্রীদের ট্যাবের মাধ্যমে বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত পড়ানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন, হেম্পেল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে এটির বাস্তবায়ন করছে ফ্রেন্ডশিপ এবং গণসাক্ষরতা অভিযান।
প্রকল্প পরিচালক শাহীন ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা এবং জামালপুরের মাদারগঞ্জের ১২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে এ প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছে। এর অধীনে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির মোট ১২ হাজার ৫৩৬ জন মেয়েশিশু রয়েছে। এ প্রকল্পটির মূল উদ্দশ্য হলো— ট্যাবের মাধ্যমে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের ওপর দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি শিশুবান্ধব ই-কনটেন্ট তৈরি করে শিক্ষাপদ্ধতিকে আরও সহজ করা। এর পাশপাশি আমরা এসব স্কুলের শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়েছি। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর সহায়তায় সেভ দ্য চিলড্রেন এটির কাজ করছে। তিনি বলেন, তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটি চলতি বছরের মে মাসে শেষ হয়ে যাবে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক (শিক্ষা) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ই-কনটেন্টের সুবিধাই হলো শিশুরা নিজেরাই লেসনগুলো বের করে আয়ত্ত করতে পারে। তবে শিশুদের সহযোগিতার জন্য রয়েছে শিক্ষক ও ইুজই প্রকল্পের কর্মকর্তারা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— ট্যাবগুলো দেওয়ার পর তাদের মধ্যে পড়ার আগ্রহ বেড়েছে, ক্লাসে উপস্থিতি বেড়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, যেসব স্কুলে ট্যাব নেই এসব স্কুলের তুলনায় ট্যাব পাওয়া স্কুলের শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে ক্লাস পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে।
ফ্রেন্ডশিপ প্রকল্পের সমন্বয়ক মো. সুরুজ মোল্লা বলেন, ২০১৯ সালে এম্পাওয়ারিং গার্লস থ্রু এডুকেশন (ইজিই) প্রকল্প শুরু হওয়ার পর পরই কোভিড-১৯ অতিমারী দেখা দেয়। ফলে প্রথম দিকে কাজে করতে চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। পরে টার্গেটকৃত মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদের প্রস্তুত করতে আমরা শিশুদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের হাতে ট্যাব তুলে দিই। বিভিন্ন সময় তাদের পড়াশোনার খোঁজখবর নিই। এর পর করোনার দীর্ঘ ছুটির পর বিদ্যালয় চালু হওয়ার পর শ্রেণিকক্ষে গ্রামীণ এ শিশুদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। দেখো অন্যদের চেয়ে তারা পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে। এতে করে শিক্ষার জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ট্যাবে পাঠদান ছাড়াও ইজিই প্রকল্পে রয়েছে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে মেয়েশিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, বিবাহ নিবন্ধনকারী ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতাদের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম।
এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। তারা বলছেন অন্যান্য স্কুলেও এর সুযোগ দিতে হবে। তা ছাড়া ছেলেদেরও এর আওতায় আনার অনুরোধ জানিয়েছেন। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন এ প্রতিবেদক। সাম্প্রতিক সময়ে এসব বিদ্যালয়ে গেলে ছাত্র, অভিভাবক ও শিক্ষকরা এমন দাবি জানান।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, রাজারহাট উপজেলার ১২৪ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে ১৮ হাজার ৫০০ এরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে, শিক্ষার গুণগত মান তৈরি করতে এবং মানসম্পন্ন শিশু তৈরি করতে হলে শিক্ষা পদ্ধতিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের খুব প্রয়োজন। এ কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য সরঞ্জাম হিসাবে ফ্রেন্ডশিপ দেওয়া ট্যাব শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করছে। এই ট্যাবটি সরকারি শিশুবান্ধব হওয়ায় স্কুলের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া শেখার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহও দেখা যাচ্ছে। আমরা শুনেছি এই প্রকল্পটি চলতি বছরের মে মাসে শেষ হবে। তাই এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করছি। এ ছাড়া এর পরিধিও বাড়াতে হবে। শুধু মেয়েদের নয়, বরং ছেলেশিশুদেরও এই সুবিধা দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চক্র বিবেচনা করি। কিন্তু শিশুদের একটা অংশ বিভিন্ন কারণে বাদ পড়ে। গত বছর তার উপজেলায় ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ শিশু ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, অসচেতনতা এবং অজ্ঞতা। কিন্তু এটা অনেক আগের চেয়ে কম আমরা এটাকে শূন্যের কোঠায় আনার চেষ্টা করছি। তাই ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে শিশুদের পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে।
রাজারহাট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে তাসনিম যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারে খুবই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। বিশেষ করে শিশুদের পড়াশোনায় আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিশুদের সঙ্গে এসব শিশুর তুলনা করলে দেখা যায়, পড়ালেখায় তারা তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার ধারণা রাখে। এ ধরনের প্রকল্প সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এটা নিয়েও কাজ করছে সরকার। একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। এ ছাড়া স্কুলগুলোও ভিন্নভাবে চেষ্টা করছে ভালো কিছু করার।
ইউএনও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এ প্রকল্পের লোকজন কিছু প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন। সেই সময় তারা ঘরে ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যাই হোক শেষ পর্যন্ত হলেও স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজটা শুরু করতে পেরেছেন তারা। এখনো অনেক পিছিয়ে আছে অন্যান্য বিদ্যালয়। যার কারণে এই প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেন, বাংলা, ইংরেজি ও গণিত ছাড়াও সিলেবাসের অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ছেলেমেয়ে সব শিশুকেই রাখতে হবে এ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হলে আমি খুশি হব।