শহীদ মিনার চত্ত্বরে সব মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তখনও তপ্ত রোদে টানা দাঁড়িয়ে অপেক্ষার সারি। কতক্ষণে প্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহের সামনে পৌঁছা যাবে। সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে কফিনে ফুল দেওয়া বা পুস্পস্তবক অর্পণ করবে। এমন অপেক্ষায় শত শত মানুষ শহীদ মিনার ঘিরে অবস্থান করছিল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত।
দুপুর সোয়া ১২টা পযর্ন্ত ফুলে ফুলে ভরে উঠে বীরের কফিন। দুপুর সাড়ে ১২টায় শহীদ মিনার মধ্যস্থলে রাখা হয় মরদেহ। রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা জানাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-পুলিশ প্রস্তুত।
তখন মুক্তিযোদ্ধা বিচ্চু জালালের সঙ্গে সঙ্গীয় যুদ্ধাদের গলা কাঁপছিল। গলার চামড়া ভেদ করে হাড়ের ইঙ্গিত শব্দোচ্চারণের তালে তালে উঠছে নামছে। ‘লাল সালাম, জাফরুল্লাহ ভাই-তোমায় লাল সালাম’।
১২টা ৩৮ মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত-বিউগল বেজে উঠলো। পুলিশের কুচকাওয়াজ শুরু। করুণ সুরের সঙ্গে শত মানুষের চোখের জল মিশে যাচ্ছে। ঝলসে উঠছিল একাত্তরের অদম্য শিহরণ। শ্লোগান। কফিনে লাল সবুজের পতাকা রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই দ্রোহকালের বীর-সেনাপতি-কমরেড ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে।
এর আগে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কাঁদছিলেন অ্যাডভোকেট মুন্নি আক্তার। উদগ্রীব তিনি বোঝাই যাচ্ছিল। হাতে বেশ কয়েকটি গোলাপ। কাছে যেতেই বলে উঠলেন, ‘স্যারতো আমার অভিভাকক ছিলেন। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়তে গিয়ে তার সান্নিধ্যে বহুবার গিয়েছি। প্রতিবারই মাথায় হাত রেখে বলেছিল, ‘ পড়াশোনা কর মানুষের জন্য, দেশের জন্য। মানুষকে ঘিরেই যেন সব হয়’।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বেড থেকে উঠে এসেছেন সত্তর বছর বয়সী জিল্লুর রহমান, সঙ্গে স্ত্রী। হাতে একটি গোলাপ। বললেন, চারদিকে ভিড়, স্যারের কাছে পৌঁছতেই পারিনি। একবার দেখবো। ফুল দেব। তার মতো শত শত মানুষ ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শহীদ মিনার চত্ত্বর লাল হয়ে উঠলো। শিমুল নেই, পলাশ নেই। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের সবুজ পাতায় সোনালী রোদ খেলা করছিল। সঙ্গে শত হৃদয়ে শ্লোগান উঠছে-জাফরুল্লাহ ভাই আমরা তোমায় ভুলবো না। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে, বিভিন্ন সড়ক মিশে যাচ্ছিল শহীদ মিনারে। সব মানুষের উপস্থিতিতে। মিনার ঘেঁষা মরা ঘাসের নিচ থেকে ধুলো উড়ছে পায়ে পায়ে। চেনা মিনার ছোট হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বীরের কফিন ঘিরে কাঁদছিলেন গাড়ি চালক রফিকুল ইসলাম। ৫টি লাল গোলাপ হাতে নিয়ে কফিনের অগ্রভাগে রাখছিল। তখন চোখের কোনায় জল টলমল করছিল। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রফিক। পেছন থেকে ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা বলছিলেন, দ্রুত করুন-শ্রদ্ধা জানাতে অনেক মানুষ এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। এমন শব্দ যেন রফিকের কানে পৌঁছেনি।
কফিনের অপর পাশে থাকা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মেয়ে বৃষ্টি রফিককে ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে কান্না করছিল। ছেলে বারিশ চৌধুরী রফিকের গালে গাল লাগিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না কেউ। শোকাহত রফিক বলল, ‘১৫ বছর ধরে স্যারের সঙ্গে ছিলাম। স্যার চলে যাচ্ছেন, আমার মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত স্যারের ওই গাড়ি আমি ছাড়বো না। তিনি আমায় পাশে বসিয়ে খাওয়াতেন। বলতেন, নতুন গাড়ি দরকার নেই। তুমি যেমন আমার আপন, পুরাতন গাড়িটাও তাই’।
চিটাং রোড এলাকা থেকে এসেছেন সাহাবুদ্দিন নামের এক বৃদ্ধা। পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। কী করবেন বোঝা যাচ্ছিল না। বোঝা গেল একটু পর। শ্রদ্ধা জানানো লাইন কিছুটা ফাঁকা হতেই ঢুকে পড়লেন তিনি। কফিনের সামনে শরীরটা টানটান করে সংগ্রামী অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। ওই সময় যা বলার তার চোখ মুখেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তার দুটি চোখ ভাসিয়ে নামছে লোনা স্রোত-যার নিশ্চিত নাম ভালোবাসা।
বৃদ্ধা সাহাবুদ্দিনের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আব্দুর রব। তার হাতে থাকা ফুল কফিনে রেখেই ডান হাত মুষ্টিগত করে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিল। চশমার নিচ দিয়ে গড়াচ্ছিল চোখের জল। শব্দ বের হচ্ছিল-জাফর ভাই, জাফর ভাই...। এমনটা বলতে বলতেই কফিনের অগ্রভাগে এক এক করে বেশ কয়েকটি চুমু খেলেন। দু’হাত দিয়ে গ্লাসের ভেতরে থাকা বীরের মুখখানি যেন ছুঁইয়ে দিচ্ছেন তিনি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত সিনিয়র একজন নার্স। বললেন, ‘স্যার আমাদের বাবা ছিলেন। শক্তি ছিলেন। স্যারের দেখানো পথেই আজীবন হাঁটবো। কেউ বলতে পারবেন, স্যার তার কথার খেলাপ করেছেন? সেই কারণেই তো মানুষের এত আবেগ তাকে ঘিরে, যা আছড়ে পড়লো সকাল থেকে বিকাল পযর্ন্ত। শহীদ মিনার থেকে সোহরাওয়াদী উদ্যান পর্যন্ত। বীরের মরদেহ সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হবে বলে আগেই ঘোষিত ছিলো। কিন্তু সকাল ৮টা থেকেই মিনারের সামনে লাইন শুরু হয়ে যায় তাকে একটিবার চোখের দেখা দেখার জন্য।
দুপুর আড়াইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জানাজার ঘোষণা হল। তখন দুপুর প্রায় একটা। মানুষের শ্রদ্ধা জানানো যেন শেষ হচ্ছে না। যখন শহীদ মিনার থেকে মরদেহ বের করা হলো-তখনও চাপা কান্নার রোল, বেরিয়ে আসা চাপা আবেগ, পুরনো স্মৃতিচারণা করছিল শ্রদ্ধা জানাতে আসা অনেকেই। শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পযর্ন্ত গোটা রাস্তায় শোকাহত মানুষের শ্রদ্ধা। শহীদ মিনার কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-পেশাগত দায়িত্ব মুর্হুতের জন্য ভুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখা গেছে সাংবাদিকদেরও।
শহীদ মিনার কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনাচার নিয়ে শোকাহত মানুষ স্মৃতিচারণ করছিল। কেউ বা জানতে চাইছেন, অসুস্থ অবস্থায় তিনি কী কী বলেছেন, কি বলতে চেয়েছেন। টুকরো টুকরো ঘটনা, কারো বা সামনে থেকে ডা. জাফরুল্লাহর মিটিং শোনার অভিজ্ঞতা, কারো বা সামনে থেকে দেখা, কথা বলার অভিজ্ঞতা, সবই যেন উঠে আসছে ঐ শোকাতুর ভিড়ের মধ্য থেকেই।
এর আগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়া একটা গোটা শহর তখন চেপে রাখা শোকাতুর যন্ত্রণায় শুনলো-‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর আমাদের মধ্যে নেই। হাসপাতাল চত্ত্বর ছাড়িয়ে দাবানলের মতো মুহূর্তের মধ্যে গোটা শহর, গোটা দেশ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো সেই ঘোষণা। যে যা-ই বলুক, ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে, মানুষের জন্য তার কাজকে।