উপকূলীয় অঞ্চলে স্থানান্তরের শঙ্কায় ৮০ ভাগ পরিবার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৩, ১২:১৩ এএম
বন্যায় ভাংছে উপকূলীয় অঞ্চল। ফাইল ছবি
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বাগেরহাটের মোংলার ৮০ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ৭০ শতাংশ পরিবার স্থানান্তরের শঙ্কায় রয়েছে। উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও মানবাধিকার, নাগরিক ও মৌলিক অধিকারহরণসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে ফেলেছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত এক গবেষণা ফলাফলে এমন তথ্য জানানো হয়।
গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি তিন মাস ধরে গবেষণাটি করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্স এন্ড ডেভেলোপমেন্ট (সিপিআরডি)।’
সংস্থাটির নির্বাহী প্রধান মো. শামছুদ্দোহা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নারীদের বিপদাপন্ন পরিস্থিতি যাচাইয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। নারীদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন স্তরে কিভাবে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে- সেটি খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষয়ক্ষতির শিকার বাস্তচ্যুত ব্যক্তি বা পরিবারগুলো তাদের মৌলিক অধিকারসহ জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে আত্ন-নিয়ন্ত্রণ, বাঁচার অধিকার, সুস্বাস্থের অধিকার, পানিপ্রাপ্তির অধিকার, জীবিকার নিশ্চয়তার অধিকার, মানসম্মত জীবনযাপন ও পর্যাপ্ত বাসস্থান প্রাপ্তি, সংস্কৃতি চর্চা ও সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি।
সেমিনারে জানানো হয়, গবেষণা পদ্ধতি এবং গবেষণা এলাকার জন্য বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়ন, চাঁদপাই ইউনিয়ন, সুন্দরবন ইউনিয়ন বেছে নেওয়া হয়। অন্যদিকে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন, বুড়িগোয়লিনী ইউনিয়ন, গাবুরা ইউনিয়নে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। প্রশ্নপত্র সমীক্ষা, এফজিডি, কেইস এবং সেকেন্ডারি ডাটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬০টি প্রশ্নপত্র সমীক্ষা (১৪৩টি মোংলায় এবং ১১৭টি শ্যামনগরে), ১৫টি এফজিডি (৫টি মোংলায় এবং ১০ টি শ্যামনগরে) এবং ১৭ টি কেইস সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র সমীক্ষা, এফজিডি এবং কেইস স্টাডিতে ১০০ শতাংশ (মোংলা এবং শ্যামনগর উভয় উপজেলায়) অংশগ্রহণকারী নারী।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের মধ্যে মোংলার ৪৫ শতাংশ এবং শ্যামনগরের ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দুর্যোগের কারণে তাদের পরিবার অন্তত একবার স্থানান্তরিত হয়েছে। মোংলায় স্থানান্তরগুলোর প্রধান কারণ সাইক্লোন এবং নদী ভাঙন। অপরদিকে শ্যামনগরে স্থান্তরের প্রধান কারণ বন্যা এবং সাইক্লোন। স্থানান্তরের পর সাধারণত পরিবারগুলো বাঁধের উপর, রাস্তার পাশে অথবা কোনো উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে থাকে। স্থানান্তরিত পরিবারগুলোর নারীদের (মোংলায় ৬৮ শতাংশ নারী এবং শ্যামনগরে ৮২ শতাংশ নারী) স্যানিটেশন সমস্যা, কাজের চাপ বৃদ্ধি, প্রতিবেশী কর্তৃক দুর্ব্যবহার, যৌন নির্যাতনের ভয় এবং বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বর্তমানে ৮০ শতাংশ পরিবার মোংলায় এবং ৭০ শতাংশ পরিবার শ্যামনগরে স্থানান্তরের শঙ্কায় রয়েছে।
গবেষাণায় আরও দেখা গেছে, পানীয়জলের অভাবে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যার মধ্যে মোংলা অঞ্চলে ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং শ্যামনগর অঞ্চলে ৭৬ শতাংশ প্রতিবেশীর খারাপ ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া উভয় এলাকায় ১০ জন ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে। দুই উপজেলায়ই ৭০ শতাংশ শারীরিকভাবে আহত হয়েছেন।
দীর্ঘ সময় ধরে লবণাক্ততার সংস্পর্শে আছেন বা ছিলেন- এমন নারীদের প্রায় সবাই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বলে উঠে এসেছে। মোংলায় ৬৪ শতাংশ এবং শ্যামনগরে ৫৪ শতাংশ নারী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। মতের মধ্যে অনেকেই জরায়ু, গর্ভাশয় ও গর্ভনালীন প্রজনন অঙ্গ অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, মোংলায় ৪১ শতাংশ এবং শ্যামনগরে ৩১ শতাংশ নারী আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পানির সমস্যা, স্যানিটেশনের সমস্যায় (টয়লেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন) ভুগে থাকেন। আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে মাসিক চক্রের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জটিলতায়ও ভুগেছেন। শ্যামনগর এবং মোংলা অঞ্চলের ৯০ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের গৃহ হারিয়েছেন অথবা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
গবেষণা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান মো. শামছুদ্দোহা, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আলোচনা করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়াম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আলোচনা করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ চাকমা, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর ডিন প্রফেসর ড. সাবিনা ফায়েজ রশীদ।
সভায় আলোচনা করেন ইউএন উইমেনের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট দিলরুবা হায়দার, জিবিভি এক্সপার্ট মাহফুজা আক্তার মালা, ডিয়াকোনিয়ার কান্ট্রি ম্যানেজার খোদেজা সুলতানা লোপা, ডিএফের সদস্য সচিব গওহার নঈম ওয়ারা, এইচইকেএস/ইপিআ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ধারা চৌধুরী ও সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের প্রতিনিধি শিরিন লীরা প্রমুখ।