Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাংলা একাডেমি ও পুরস্কার সমাচার

Icon

ড. মাহফুজ পারভেজ

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা একাডেমি ও পুরস্কার সমাচার

ছবি: সংগৃহীত

পুরস্কার ঘোষণা, স্থগিত ও প্রদানবিষয়ক এক মজার রম্য-নাটক মঞ্চস্থ হলো সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। নাটকীয়তার ঘটনাস্থল বাংলা একাডেমি। একুশে উপলক্ষ্যে জানুয়ারির শেষদিকে প্রতিষ্ঠানটি যথারীতি পুরস্কার ঘোষণা করে। ঘোষণার পরপরই নিন্দা ও প্রতিবাদের তোড়ে পুরস্কার স্থগিত করা হয়। অবশেষে প্রথমে ঘোষিত তালিকার কাউকে কাউকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য রাখা হয় এবং কাউকে কাউকে পুরস্কারের খাতা থেকে নাম কেটে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রথম তালিকায় ঘোষিতদের মধ্যে আংশিক পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষমাণ আর আংশিক বঞ্চিত। এরূপ ঘটনাবলির মধ্যে রঙ্গরস যেমন আছে, বহু প্রশ্নও আছে।

একদিকে, পুরস্কার ঘোষণা করে ফিরিয়ে নেওয়া নিশ্চয় খুব ভালো কাজ নয়। অন্যদিকে, পুরস্কার ঘোষণার পর স্থগিত করে কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে দেওয়াও শোভন নয়। এতে ঘোষিত হওয়ার পর স্থগিত থেকে ফের পুরস্কারপ্রাপ্ত হওয়া এবং ঘোষণা ও স্থগিতের ধাক্কাধাক্কিতে পুরস্কারবঞ্চিত হওয়া, এ উভয় শ্রেণির মধ্যে কে সম্মানিত হলেন আর কে অপমানিত হলেন, তা গবেষণার বিষয় বৈকি! আর পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির দক্ষতা, যোগ্যতা সম্পর্কেও একটা ধারণা স্পষ্ট হয়েছে মানুষের মধ্যে। সেটা হলো এই যে, আগে বাংলা একাডেমি সমালোচিত হয়েছে সরকারের তোষণ ও পক্ষপাতের মাধ্যমে পুরস্কার দেওয়ার জন্য। এবার পুরস্কার প্রদান, স্থগিত ও আবারও প্রদানবিষয়ক নাটক দেখিয়ে সবার হাসির পাত্র হলো। ‘সমালোচিত হওয়া’ ও ‘হাসির পাত্র’ হওয়ার মধ্যে সম্মানের উপাদান কত কম আর অপমানের উপাদান কত বেশি, সেটি জানার জন্য নিশ্চয় গবেষণার প্রয়োজন হয় না।

আদপে রাজনৈতিক পদলেহন, আমলাতান্ত্রিকতা, লেজুড়বৃত্তি ও বশংবদ মানসিকতার জন্য প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কারের পতন ও অবক্ষয় হয়েছে চোখে পড়ার মতো। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকার চেয়ে পুরস্কার না পাওয়াদের তালিকায় থাকা নামগুলোই যখন উজ্জ্বল দেখায়, তখন পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াই বরং সম্মানের। পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রবর্তিত হয় ১৯৫৫ সালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাননি। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র লেখকের তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি অভিন্ন। যে স্বীকৃতি পৌঁছুতে পারেনি আহমদ ছফা বা শহীদুল জহিরের কাছে, তার খুব একটা মান ও গুরুত্ব আছে কিনা, সেটাই বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়। এক্ষেত্রে অধিক আলোচনা অর্থহীন। তবে, একটি বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির পর প্রথা, প্রতিষ্ঠান, পুরস্কার সম্পর্কে এক আশার জায়গা তৈরি হয়েছিল বটে। সে আশায় আপাতত গুড়ে বালি।

আশাহত হওয়া যদিও বেদনার, তথাপি জাতিগতভাবে আশাভঙ্গ হওয়াই যেন আমাদের নিয়তি। বিশেষত রাজনৈতিক আশা ভেঙেছে অনেকবার। সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের স্বপ্ন বিচূর্ণ হয়েছে বারবার। যার মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক সুশাসনের প্রত্যাশা। তুলনায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আশাও দুরাশায় পরিণত হয়েছে অনেকবার। এজন্যই নানা ভেকধারীর আগ্রাসন ও আধিপত্য সহ্য করতে হয়েছে মানুষকে।

জুলাই-আগস্ট (২০২৪) পরিবর্তনের ফলে আবারও একটি আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গঠিত সরকার গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের সরকারগুলোর মতো নয়। তারা দলীয় সরকার নয় বলে তাদের সামনে দলীয় মতাদর্শভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা এখন পর্যন্ত নেই। তাদের ঘোষিত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা এবং অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার যতদূর সম্ভব অবসান ঘটানো। বাংলা একাডেমি সরকারের মূল লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে এবং গোত্র ও গ্রুপের পক্ষপাত ও বৈষম্যের বাইরে বের হতে পারেনি। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে, বাংলা একাডেমির আমূল সংস্কার, পুরস্কার কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের শাস্তিসহ চার দফা দাবিতে প্রতিষ্ঠানটি ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ‘বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ’, ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ ও ‘জুলাই রাজপথ’ নামের তিনটি প্ল্যাটফর্ম এ কর্মসূচি পালন করে। পরে একাডেমির মহাপরিচালকের হাতে দাবিগুলো তুলে দিয়ে মেনে নেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

কর্মসূচিতে উত্থাপিত বক্তব্যগুলো প্রণিধানযোগ্য। আমলাতান্ত্রিক কর্তাদের কানে এসব কথা ঢুকবে বলে মনে হয় না। কারণ, বক্তারা বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বাংলা একাডেমিতে প্রথম আলো গংয়ের মহাপরিচালক রেখে কোনো সংস্কার সম্ভব নয়। কারণ তিনি খুনি হাসিনা ও ফ্যাসিস্টের সহযোগীদের বিতাড়িত না করে উলটো পুনর্বাসন করছেন। এমনকি তাদের দিয়ে পুরস্কার নির্বাচন ও বাছাই করায় বাংলা একাডেমির সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।’

প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, ‘কীভাবে একটি বিশেষ মিডিয়ার কর্মী সাজ্জাদ শরীফ সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে নোংরা হস্তক্ষেপ চালান? দেশে অনেক বিখ্যাত ও প্রবীণ কবি থাকতে ফ্র্যাংকফুটের বইমেলায় তাকে পাঠানো হয়েছিল কোন যুক্তিতে?’

কর্মসূচিতে কবি মাহবুব হাসান, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, শাহীন রেজা, আবিদ আজম, সামসুদ্দিন হিরা, ফারুক হোসেন খান, রাসেল আহমেদ, পলিয়ার ওয়াহিদ, সৈয়দ রনো, শাকিল মাহমুদ, মঈন মুনতাসীর, নাট্যকার হুসনী মোবারক, লেখক-প্রকাশক মোরশেদ আলম হৃদয় প্রমুখ বক্তব্য দেন। মাহবুব হাসান বলেন, ‘যারা দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদের দালালি করে এসেছেন, তাদের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। নাটকের ব্যক্তিকে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের পুরস্কার স্থগিত করা হয়েছে। আমরা চাই, তাদের পুরস্কার বাতিল করা হোক।’

আবিদ আজম বলেন, ‘অবিলম্বে বাংলা একাডেমির পুরস্কার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে।’ শামস মুসা বলেন, ‘বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ পলিয়ার ওয়াহিদ বলেন, ‘জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি পুরস্কারকে কলঙ্কিত করেছেন প্রথম আলোর সাজ্জাদ শরীফ। সরকারকে বিব্রত করতে তিনি পুরস্কার কমিটিতে নোংরা হস্তক্ষেপ করেছেন। এমনকি নিজের বন্ধু ও ভাইকে পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছেন।’

যেসব দাবিতে ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়, সেগুলো হলো- বাংলা একাডেমি থেকে ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের অপসারণ করতে হবে; একাডেমির নির্বাহী পরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাহী পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে; পুরস্কার বিতর্কিত করায় সাজ্জাদ শরীফকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং নতুন মনোনয়ন, প্রস্তাবনা ও বাছাই কমিটিতে জুলাই স্পিরিটের কবি-লেখকদের রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, সাজ্জাদ শরীফ বিতর্কের মুখে ২৯ জানুয়ারি একাডেমির মহাপরিচালকের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। পদত্যাগের কারণ জানিয়ে ৩০ জানুয়ারি সকালে গণমাধ্যমকে সাজ্জাদ শরীফ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাংলা একাডেমি এবং একাডেমির মহাপরিচালক, নির্বাহী পরিষদের পদগুলোর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ায় নৈতিক কারণে আমার পক্ষে এ পদে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। আমি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি।’

প্রসঙ্গত, ২৩ জানুয়ারি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ ঘোষণা করা হয়। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পরদিন ২৪ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। পুরস্কারে লেখকদের তালিকায় কোনো ‘নারী লেখক’ না থাকাকে ‘বিস্ময়কর’ বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। এ পুরস্কারের জন্য ‘মনোনয়ন প্রক্রিয়া সংস্কারের সময় এসেছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হওয়ায় পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা ২৫ জানুয়ারি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি। তাছাড়া সংস্কৃতি উপদেষ্টা নিজেই পুরস্কার স্থগিতের খবর ফেসবুক পোস্টে জানান। পুরস্কার স্থগিতে উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে ফেসবুকে লেখেন কেউ কেউ। বিষয়টি নিয়ে পুরস্কারের জুরি সদস্যরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। জুরি সদস্য মোরশেদ শফিউল হাসান দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন ২৮ জানুয়ারি রাতে। মোরশেদ শফিউল হাসান জানান, সংস্কৃতি উপদেষ্টার পরপর দুটি ফেসবুক পোস্ট পড়ার পর তিনি ‘আত্মসম্মানবোধ থেকে এবং নিজের বিচারবুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে’ এ প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছেন।’

পুরস্কার স্থগিতের বিষয়ে বাংলা একাডেমির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উদ্ভূত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং পুরস্কার-তালিকাভুক্ত কারও কারও সম্পর্কে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় পূর্বঘোষিত ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’-এর পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন মনে করেছে একাডেমি। পরে ২৯ জানুয়ারি মধ্যরাতে বাংলা একাডেমি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পুরস্কারের জন্য দশ জনের তালিকা থেকে তিনজনকে বাদ দিয়ে সাতজনের নতুন তালিকা ঘোষণা করে।

মোদ্দা কথায়, পুরস্কার ঘোষণা, স্থগিত ও প্রদানবিষয়ক নাটকীয়তা বাংলা একাডেমি এবং এর পুরস্কারকের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার হানি ঘটিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ার ভাবগাম্ভীর্য ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে তলানিতে নিয়ে এসেছে। বিপ্লবাত্মক পরিবর্তিত পরিস্থিতির কোনো ছাপ রাখার বদলে প্রতিষ্ঠানটি অতীতের গতানুগতিক চরিত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্রের কাছে নতজানু হওয়ার পুরোনো অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করেছে মাত্র। এ অবস্থায় বিগত আমলাতান্ত্রিকতার নমঃ নমঃ মানসিকতা থেকে বিপ্লবের সঙ্গে লাগসই চরিত্র ধারণ করা বাংলা একাডেমির পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কিনা, বলা মুশকিল। বরং আশঙ্কা হয়, বাংলা একাডেমির ভূতের দৌরাত্ম্যরে মতো একুশে ও স্বাধীনতা পদকের মতো জাতীয় পুরস্কারের ক্ষেত্রেও একই হাস্যকর নাটক মঞ্চস্থ হয় কিনা!

প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম