পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনরায় বিচার কি সম্ভব?
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:০০ পিএম
তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের সদর দপ্তরে বিডিআর সদস্যরা। ছবি: বিবিসি বাংলা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারও ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আলোচনা সামনে এসেছে। নতুনভাবে সামনে আসছে নানা অভিযোগ আর ষড়যন্ত্রের আলোচনা।
এ ঘটনায় রাজনৈতিক দোষারোপ আগেও হয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অতীতে একাধিকবার এর পেছনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন। একইভাবে শেখ হাসিনাও বারবার আঙুল তুলেছিলেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে।
পিলখানা ঘটনার ১৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন পুনরায় তদন্তের দাবি আসছে বিভিন্ন তরফ থেকে। সে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সেনা ও বিডিআর পরিবার তো বটেই, তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদও ভিডিও বার্তায় সেই দাবি তুলেছেন।
সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতে সরকারের সহযোগিতা না করার অভিযোগও করেছেন। যদিও তার বিরুদ্ধেও এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে এসেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল।
সেনাবাহিনী ও তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের পরিবারগুলোর অনেকে ঘটনাটিকে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ বলতে চান না। তাদের মতে পুরো বিষয়টিই ছিল ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আসছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতের নাম।
বিডিআর নায়েক শামছুল ইসলামের সন্তান জুয়েল আজিজ বলেন, পিলখানার গণ্ডগোলটা যদি না হতো তাহলে এই সরকার এতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। কারণ পিলখানার ঘটনা দিয়েই সেনাবাহিনীকে দমন করে সরকার এতদিন ক্ষমতায় ছিল।
বিডিআর পরিবারের আরেক সদস্য আইনজীবী আব্দুল আজিজ ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, বড়াইবাড়ি যুদ্ধে আমার আব্বু বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রধান সহকারী ছিল বলে তাকে টার্গেট করা হয়।
২০০১ সালে কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ি গ্রামে (রৌমারী সীমান্তে) ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় যেখানে ১৬ জন বিএসএফ ও ২ জন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সেনা নিহত হয়।
আব্দুল আজিজের বাবা আব্দুর রহিম তৎকালীন বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে জানান আব্দুল আজিজ।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তাকে আসামী করা হয় এবং কারা হেফাজতে তার মৃত্যু হয় ২০১০ সালে।
সে ঘটনায় আগের অপমৃত্যুর মামলা থাকলেও এখন নতুন করে সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেছেন আব্দুল আজিজ।
সেখানে অভিযুক্ত তালিকায় এসেছে শেখ হাসিনা, জেনারেল আজিজ আহমেদ, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসানুল হক ইনু, এমন বেশ কিছু নাম।
এছাড়াও তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মহাপরিদর্শক, জেল সুপার, দায়িত্বরত ডাক্তারসহ ২০০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আব্দুল আজিজ ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ঐক্য’ নামের সংগঠনের যথাক্রমে আহবায়ক।
নয় দফা দাবি নিয়ে সংগঠনটি ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ শুক্রবার বিকাল তিনটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছেন।
পিলখানায় নিহত সেনাসদস্যদের পরিবারের তরফ থেকেও বেশ কিছু দাবি সামনে আনা হয়েছে। এর মাঝে আগের সব তদন্ত প্রতিবেদন বিস্তারিত প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত বা চাকরীচ্যুত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, নির্দোষ বিডিআর সদস্যদের মুক্তির মতো বিষয়ও রয়েছে।
এর পাশাপাশি আগেকার তদন্তে যেসব নাম উঠে আসেনি সেগুলো সামনে আনা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন সাকিব রহমান, যিনি প্রয়াত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের সন্তান ও আইনজীবী।
আগেকার মামলায় যাদের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তারা ‘হয়তো সেই অ্যাকশনের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এটার মাস্টারমাইন্ড যারা কিনা পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে, তাদেরকে বের করাটাই আমাদের মুল উদ্দেশ্য,’ বলেন রহমান।
বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবশ্য পুনরায় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। যিনি তৎকালীন সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির দায়িত্বে ছিলেন।
‘সঠিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শীঘ্রই শুরু করা হবে’ বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ১৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় উচ্চ আদালতে মোট ৮৩৫ আসামীর শুনানি শুরু হয়।
২০১৭ সালে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় ২২৮ জনের। খালাস দেয়া হয় ২৮৩ জনকে। পূর্ণাংগ রায়টি প্রকাশ হয়েছিল ২০২০ সালে।
এখনও আপিল বিভাগে ঝুলছে অনেকের আবেদন। ঝুলছে বিস্ফোরক মামলাও। তবে ১৫ বছর পর এসে নতুন করে তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের জায়গা রয়েছে।
‘এটার মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন আলামত, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স, এবং ঐ সময়কার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সাক্ষ্যপ্রমাণের বিষয়গুলো হয়তো অনেক সময় এভেইলেবল থাকবে না,’ বলছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান।
তবে আগের যেসব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে আগে হয়তো সাক্ষ্য দিতে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, বা আগে দিতে পারেননি এমন হলে এখনও তদন্ত সম্ভব বলে জানান তিনি।
‘যদি বিষয়টি এমন হয় যে পুনঃতদন্ত চাওয়া হচ্ছে এইজন্য যে যাদের সংযোগে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে বা কী কারণে সংগঠিত হয়েছে, মোটিফ কী ছিল, এই জায়গাগুলো বের হয়ে আসেনি সেটি আমার মনে হয় এই পর্যায়েও সফলভাবে করা সম্ভব,’ বলেন খান।
আগের বিচারপ্রক্রিয়ায় যে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করার অভিযোগ এসেছে, পুনরায় তদন্তের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনার যেন না আসে এবং আসলেই যারা পরিকল্পনার সাথে জড়িত সেটা সঠিকভাবে সামনে আনার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
পিলখানার ঘটনাটির পরিসর বেশ বড়। পূর্ণাঙ্গ বিচারও প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। ১৫ বছরে অনেকের সাজা ভোগ শেষ হয়েছে, অনেকে অপেক্ষায়, আবার অনেকে মারাও গেছেন। তবে এনিয়ে অনেক ধরণের আক্ষেপের জায়গাও রয়ে গেছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এখন নতুন মাত্রা যুক্ত হবে কিনা সেদিকে নজর থাকবে সামনের দিনগুলোতে।