সার আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে গত জুনেই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা স্থগিত করেছে সোনালী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকটি শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খুলবে না-এ মর্মে জানিয়ে দিয়েছে বিএডিসিকে। অন্যদিকে বিদেশি সরবরাহকারীরাও অপারগতা জানিয়েছে সার দেওয়ার বিষয়ে। কারণ তাদের বকেয়া পাওনা বিএডিসির কাছে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮৭২ কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারিভাবে সার আমদানিতেও ভাটা পড়েছে। ব্যাংক খাতের বিদ্যমান অস্থিরতার কারণে সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বানের পরও সায় মিলছে না বেসরকারি পর্যায় থেকে। একই সময়ে দেশে সারের মজুত ফুরিয়ে আসছে। চাহিদার মাত্র দুমাস চলবে বর্তমান মজুত দিয়ে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
উল্লিখিত তথ্য তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টার কাছে গত ১৩ আগস্ট চিঠি দিয়েছেন কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার। যদিও একদিন পরই ১৪ আগস্ট চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয় তার। সেখানে নতুন সচিব হিসাবে যোগদান করেছেন ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বিদ্যমান পরিস্থিতি কাটাতে বিদেশি সরবরাহকারীদের বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের কাছে দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বিএডিসির পক্ষে এলসি স্থাপনের জন্য সোনালী ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
সূত্রমতে, এই মুহূর্তে দেশের ভেতর ইউরিয়া সারের মজুত আছে ৫ লাখ ৭০ হাজার টন, এর মোট চাহিদা ২৭ লাখ মেট্রিক টন। টিএসপি সারের মজুতের পরিমাণ ৩ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন, আর মোট চাহিদা ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। এছাড়া ডিএপি সারের ১৫ লাখ টনের চাহিদার মধ্যে মজুত আছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন এবং সাড়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন এমওপি সারের চাহিদার বিপরীতে মজুত আছে ৪ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন।
অর্থ উপদেষ্টাকে অবহিত করে চিঠিতে বলা হয়, দেশে যে সারের মজুত আছে তার মধ্যে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরিয়া এবং পরবর্তী মাস অক্টোরব পর্যন্ত নন-ইউরিয়ার চাহিদা পূরণ সম্ভব। এরপর অক্টোবরেই শুরু হবে রবি মৌসুম। যেখানে ৪০ লাখ মেট্রিক টন সারের প্রয়োজন দাঁড়াবে। কিন্তু বিদেশ থেকে সার আমদানির লিড টাইম ৯০-১২০ দিন। অর্থাৎ আজকে আমদানির এলসি খোলা হলেও আগামী তিন মাস সময় লাগবে দেশে পৌঁছতে। ফলে এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে সার আমদানির প্রয়োজন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন সদ্য বিদায়ি কৃষি সচিব। আর সেটি শুরু করা না গেলে আগামী অক্টোবর থেকেই সার সংকটসহ নানাবিদ সমস্যা দেখা দেবে এমন আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরিয়া সরকারের আমদানি ব্যাহত হলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটবে, যা দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিতভাবে হুমকির মুখে ফেলবে।
এদিকে গত ১২ আগস্ট অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার দিনই সার, জ্বালানি তেল ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাতে ডলার সংকটের অজুহাত না দেখাতে পারে।
সূত্রমতে, বিভিন্ন দেশ থেকে সার আমদানির পর নির্ধারিত সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি বিএডিসি। কারণ দেশে ডলারের সংকট রয়েছে। ফলে এখন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিএডিসির কাছে সারের মূল্য বাবদ বকেয়া পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ডলার, দেশীয় মুদ্রায় ১৮৭২ কোটি টাকা। বকেয়া বিলের অর্থ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাপ প্রয়োগ করছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এদিকে ২০০৮ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা থেকে সার আমদানি করছে বিএডিসি। এক্ষেত্রে সরকারি গ্যারান্টি নিয়ে এলসি খুলে আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত নন-ইউরিয়া সার আমদানির এলসি খুলে আসছে ব্যাংকটি। কিন্তু ডলার সংকট দেখিয়ে গত জুন মাস থেকে এলসি খোলা স্থগিত করে দেয় সোনালী ব্যাংক। এতে সার আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। সূত্র জানান, সার আমদানির এলসি খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাব বিএডিসির পক্ষ থেকে পাঠানো হয়। কিন্তু শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খুলতে অপারগতা জানায় ব্যাংকটি। আর নিজস্ব কোনো মূলধন না থাকায় বিএডিসির সার আমদানিতেও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এরপর দেশে শুরু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই পরিস্থিতিতে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও তাতে সায় পায়নি বিএডিসি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি এক সার আমদানিকারক জানান, ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেক ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও ব্যাংক দখল ও পালটা দখল চলছে। ব্যাংকের ভেতর গোলাগুলি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নতুন নিয়োগ দেওয়া হলেও বেশ কিছুদিন অস্থিরতা ছিল সেখানে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি আমদানিকারকরা সার আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
এদিকে গ্যাস সংকটে অধিকাংশ ইউরিয়া সার কারখানা বন্ধ থাকায় সারের এই সংকট আরও জটিল রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) আওতাভুক্ত পাঁচটি সার কারখানার মধ্যে চারটিই এখন বন্ধ গ্যাস সংকটে। একমাত্র চালু আছে ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা; নতুন কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৯ লাখ ২৪ হাজার টন। সে তুলনায় দেশের ইউরিয়ার চাহিদা বছরে ২৭ লাখ টন।