বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকাসহ সারা দেশের বহু থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় বেশিরভাগ থানার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে স্বল্প পরিসরে অনেক থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
রোববার পর্যন্ত সারা দেশে ৫৯৯টি থানার কার্যক্রম স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। এছাড়া ঢাকার কয়েকটি সড়কে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও স্বল্প পরিসরে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন।
তবে থানাগুলোতে পুলিশ সদস্যরা আসতে শুরু করলেও কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হতে আরও সময় লাগবে। কম ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোতে পুলিশ সদস্যরা হাজির হলেও তেমন কোনো কাজ নেই। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি থানায় শিক্ষার্থীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। কিছু থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেওয়ার কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তার স্বার্থে সব থানাতেই সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে পুলিশের সব সদস্যকে কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘাত ও সহিংসতায় বেশিরভাগ থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ৪২ জনের মতো পুলিশ সদস্য নিহত ও আরও অনেকে আহত হন। এছাড়া পুলিশের গুলিতে কয়েকশ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরে থানাগুলো পুরোপুরি পুলিশ শূন্য হয়ে পড়ে। এছাড়া ডিবি কার্যালয় থেকেও পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান।
পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৮ আগস্ট থেকে পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির (ঢাকা মহানগর পুলিশ) কার্যালয় খোলা হয়। তবে সেদিন দুটি কার্যালয়ে পুলিশ সদস্যদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। এর মধ্যে নবনিযুক্ত আইজিপি দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ সদস্য কাজে ফেরেননি। তবে ধীরে ধীরে থানাসহ অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ছে। এর মধ্যে রোববার রাজধানীর কিছু পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। শিগগির পুরো রাজধানীতে তারাও কাজ শুরু করবেন বলে আইজিপি জানিয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর রোববার এক খুদে বার্তায় জানায়, সারা দেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া ১১০টি মেট্রোপলিটন থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৫০২টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর আগে শনিবার পর্যন্ত ৫৩৮টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যক্রম শুরু হওয়া বেশিরভাগ থানায় সীমিত পরিসরে কাজ চলছে।
যাত্রাবাড়ী থানায় অভিযোগ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা : যাত্রাবাড়ী থানা পুরোপুরি কাজ শুরু করতে আরও সময় লাগবে। তবে থানায় পুলিশ সদস্যরা যোগ দিলেও কাজ শুরু করেননি। থানায় গিয়ে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ অন্যরা। থানার সামনে টিনশেডে বসে শিক্ষার্থীরা মানুষের অভিযোগ (জিডি) নিচ্ছেন।
কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, কিছু পুলিশ সদস্য যোগ দিলেও তারা কাজ শুরু করেননি। ভুক্তভোগী মানুষের অভিযোগ ছাত্র-পুলিশ মিলেই নিচ্ছে। ছোটখাটো অভিযোগ হলে শিক্ষার্থীরা টিম গঠন করে তদন্তপূর্বক তাৎক্ষণিক সমাধান করে দেওয়া হচ্ছে। আর জটিল অভিযোগ হলে সেনাবাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া বেশিরভাগ অভিযোগ হলো- জমিদখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ভাঙচুর ও দোকান লুটপাটসংক্রান্ত।
এদিকে, কদমতলী থানায় রোববার পর্যন্ত কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। থানার ভেতরে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
বাড্ডা ও ভাটারা থানায় ফিরেছে পুলিশ : ভাটারা থানা ৫ দিন বন্ধ থাকার পর শুক্রবার থেকে পুলিশ সদস্যরা ফিরতে শুরু করেছেন। গুলশান থানার পাশে একটি নতুন ভবনে ভাটারা থানার আপৎকালীন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, পুরোনো থানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। রোববার সরেজমিন ভাটারার পুরোনো থানায় গিয়ে দেখা যায়, সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা বাইরে অবস্থান করছেন। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করতে এলে তাদের গুলশান থানার পাশে ভাটারা থানার নতুন ভবনে যেতে বলা হয়।
ভাটারা থানার ওসি মো. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, শুক্রবার থেকে তারা থানায় অবস্থান নিয়েছেন। থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করতে আরও সময় লাগবে। তিনি সবাইকে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানান।
এদিকে, বাড্ডা থানায়ও অনেক পুলিশ সদস্য ফিরেছেন। দুপুরে সরেজমিন বাড্ডা থানায় গিয়ে দেখা যায়, যোগদানকৃত পুলিশ সদস্যরা বাইরে অবস্থান করছেন। ভেতরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন।
এ বিষয়ে বাড্ডা থানার ওসি মো. আব্দুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের বেশিরভাগ সদস্য যোগদান করেছেন। যারা গুরুতর আহত হয়েছেন, তারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় পরিচ্ছন্নতা : মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় পুলিশ সদস্যরা একে একে এসে হাজির হচ্ছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা থানার ভেতর ভাঙচুর ও পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন। কেউ কেউ আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া দেওয়াল পুরাতন কাপড় ও পানি দিয়ে মুছে দিচ্ছেন। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় প্রায় সব পুলিশ সদস্য হাজির হয়েছেন।
ঢাকায় কাজ শুরু করেছে ট্রাফিক পুলিশ : প্রায় ৬ দিন পর রাজধানীর কিছু সড়কে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। ইন্টারকন্টিনেন্টাল সিগন্যাল থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কাজ করতে দেখা গেছে। একইসঙ্গে সড়কগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনতাকে ট্রাফিক শৃঙ্খলার কাজ করতে দেখা গেছে।