চলতি বছর দেশের ইতিহাসে গত ৫২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০৩৪ সালে এরকম হিটওয়েভ বা তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে।
‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিটওয়েভস ইন বাংলাদেশ : হিস্টোরিক্যাল ট্রেন্ডস, প্রেজেন্ট চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ফিউচার প্রজেকশন্স’ শীর্ষক এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (এসডো)’।
মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির ‘উইমেন’স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউভিএ)’ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এ সময় জানানো হয়- বাংলাদেশে ৩ দিনের বা তার বেশি অস্বাভাবিক গরম (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) আবহাওয়াকে হিটওয়েভ বা তীব্র তাপপ্রবাহ হিসাবে ধরা হয়। দেশে ১৯৯৪, ২০০৪ এবং ২০২৪ সালে এমন চরম তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে হিটওয়েভ আঘাত না এলেও বেশ কয়েকটি ঘটনা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফারেনহাইট (৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে। এই ধরনের তীব্র তাপপ্রবাহের ঘটনা প্রায় প্রতি দশকে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এই প্রবণতা অনুসরণ করে বলা যায়, ২০৩৪ সালে আরেকটি চরম তাপপ্রবাহ ঘটবে।
গবেষণার উদ্দেশ্য : বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ এবং এর প্রবণতা নির্ণয়ের জন্য পূর্বের তাপমাত্রার তথ্য মূল্যায়ন; তাপপ্রবাহের প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ; জনস্বাস্থ্য, কৃষিক্ষেত্রে এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে সৃষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা মূল্যায়ন এবং তাপপ্রবাহের ভবিষ্যৎ প্রবণতা সম্পর্কে পূর্বাভাস তৈরি।
গবেষণার জন্য ১৯৭২ সাল থেকে তাপপ্রবাহের রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সময় তাপমাত্রা প্রায় ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিলে তা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। যার কারণে (তীব্র তাপপ্রবাহ) এ বছর ১৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। ২০২৩ সালে তাপপ্রবাহের কারণে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।
চলতি বছরের ১৭ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানী ও অন্যান্য জায়গার গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ বছরের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আরও শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে, ২০৫০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেড়ে যাবে।
স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব : গবেষণার জন্য এপ্রিলে লালমাটিয়া ও মোহাম্মাদপুর এলাকার শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেখা গেছে, ঢাকার ৮০ শতাংশ শ্রমজীবী যারা ফল এবং সবজি বিক্রি করে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হন। এর মধ্যে ডিপ্রেশন, মাথাব্যথা, পানিশূন্যতা উলেযোগ্য। এ সমস্যাগুলো তাদের আগের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ওপর প্রভাব ফেলে, অ্যাজমা এবং ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়।
দেখা গেছে তাপপ্রবাহের দুই দিন পর কলেরার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব বাড়ে, যা ডায়রিয়ার প্রধান কারণ। হিটওয়েভ মশা দ্বারা সংঘটিত রোগের প্রভাব বাড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০-এর দশকে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ এবং ২০৫০-এর দশকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
পরিবেশে এবং আর্থ-সামাজিক প্রভাব : তাপপ্রবাহ বাংলাদেশের প্রতিবেশ, কৃষিক্ষেত্র এবং শহরাঞ্চলের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। এছাড়া কৃষিজমির ওপর অতিরিক্ত চাপ, বন উজাড় এবং শহরাঞ্চলে তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এটা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে, পানির প্রাপ্যতা কমে যায়। ২০২১ সালের তাপপ্রবাহে ২১ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ধান নষ্ট হয়েছে।