প্রত্যয় স্কিম কী, যে কারণে বিরোধিতা করছেন শিক্ষকরা
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:৫১ এএম
সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সরকারের আনা নতুন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ স্কিম। দেশের চার শতাধিক স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। তবে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছেন শুরু থেকে। মূলত কী আছে এ কর্মসূচিতে, কেন বিরোধিতা শিক্ষকদের।
সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখে, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তারা টাকা রাখেন সিপিএফে। পেনশনে যাওয়ার পর তারা এই টাকা পেয়ে থাকেন।
অর্থ বিভাগ বলেছে, বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। প্রত্যয় কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ১০ শতাংশ। বিদ্যমান সিপিএফ–ব্যবস্থা থেকে তা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। প্রত্যয় কর্মসূচিতে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে ওই কর্মচারী মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।
প্রত্যয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা—এ দুয়ের মধ্যে যেটা কম তা তাদের বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ জমা হবে পেনশন কর্তৃপক্ষের তহবিলে। অর্থ বিভাগ বলেছে, ৩০ বছর ধরে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে চাঁদা জমা হবে ৯ লাখ টাকা আর সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর মোট চাঁদা হবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।
অর্থ বিভাগ আরও বলেছে, পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এ অংক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বৃদ্ধি পেলে মাসিক পেনশনের পরিমাণও বাড়বে। পেনশন কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ এবং পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত। এ কর্মসূচিতে নিবন্ধিত কর্মচারীরা পেনশন পাওয়ার উপযুক্ত হওয়ার পরের মাস থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের ব্যাংক হিসাবে মাসিক পেনশনের অর্থ পেয় যাবেন। মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তাদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। পেনশন পেতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো দপ্তরে যাওয়ার বা কোনো ধরনের প্রমাণ দেখানোরও প্রয়োজন হবে না।
প্রত্যয় স্কিম ঘোষণার পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এটি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন, অর্ধদিবস কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। কিন্তু শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে সোমবার থেকে ‘প্রত্যয় স্কিম’ চালু করেছে সরকার। প্রতিবাদে এ দিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ থাকে লাইব্রেরিও। ফলে অচলাবস্থায় পড়েছে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা। তারা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। তবে শিক্ষকরা বলছেন, তারা পরবর্তীতে বিশেষ ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন। এদিকে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউ। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। যেটা আগে কাটা হতো না। এ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। সব থেকে বড় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না।
তারা আরও বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। আর তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংবিধিবদ্ধ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর যোগ দেবেন, সরকার তাদের সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করবে। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৪০০ সংস্থা রয়েছে। যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৪ লাখের বেশি। এ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ফটকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া। এর পর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একে একে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে সোমবার অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তন এবং প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যেসব সুবিধা কমবে: নতুন অর্থবছরের সর্বজনীন পেনশনের কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ এর অধীনে থাকবে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা।
এতে বলা হয়েছে, এ সব প্রতিষ্ঠানের অধীনস্থ যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ জুলাই থেকে চাকরিতে যোগ দেবেন, তাদের জন্য এ কর্মসূচি প্রযোজ্য হবে।
বিদ্যমান পেনশন স্কিম অনুযায়ী, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে পেনশন পান সে জন্য বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হয় না। নতুন স্কিমে কাট হবে ১০ শতাংশ।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেউ অধ্যাপক পদ থেকে অবসরে গেলে গ্র্যাচুইটি পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, নতুন স্কিমে সেটি পাওয়া যাবে না।
অবসরে গেলে অধ্যাপকরা এখন মাসিক পেনশন পান ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা যার বিপরীতে বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হবে না।
প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে বেতন থেকে কেটে ও প্রতিষ্ঠানের টাকায় পেনশন পাওয়া যাবে মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এককালীন কোনো টাকা পাবেন না পেনশনাররা।
বর্তমানে প্রতি বছর পেনশনে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট হলেও প্রত্যয় স্কিমে সেটি বাড়বে না।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছরে, কর্মকর্তারা ৬২ এবং কর্মচারীরা ৬০ বছরে অবসরে যান।
নতুন ব্যবস্থায় সবাইকে অবসরে যেতে হবে ৬০ বছর বয়সে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পেলেও সেই ব্যবস্থা নেই নতুন পেনশন স্কিমে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ও বৈশাখী ভাতা কিংবা এলপিআর সুবিধা পান। কিন্তু নতুন পেনশন স্কিমে সেটি থাকবে কিনা সেটি স্পষ্ট করা নেই।