চামড়া খাতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুবাতাস, সুফল নিয়ে শঙ্কায় মৌসুমি ক্রেতারা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪, ০৯:৪৭ পিএম
চমড়াশিল্প। ফাইল ছবি
মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুবাতাস বইছে চামড়া রপ্তানি খাতে। বর্তমান এক ডলারের বিপরীতে ১১৭ টাকা পাচ্ছেন এ শিল্পের রপ্তানিকারকরা। কয়েক দিন আগ পর্যন্ত পেয়েছেন ১১০ টাকা।
মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় আসছে চামড়া খাতে। সে প্রেক্ষাপটে সরকারও কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার মূল্য গত বছরের চেয়ে প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বাড়িয়েছে। তবে আসন্ন ঈদে পশুর চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাবে কিনা- তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন মৌসুমি ক্রেতারা। কারণ এর আগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন একদিনের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, চামড়া পাচার প্রতিরোধে সীমান্ত অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। কাঁচা চামড়া যাতে সীমান্ত অভিমুখে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার বাইরের চামড়া নির্দিষ্ট অঞ্চলে ৭ দিন সংরক্ষণ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া আসন্ন কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়া বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, ক্রয়-বিক্রয়, সংরক্ষণ ও পরিবহণসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকি করতে বাণিজ্য সচিব মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে প্রধান করে ১৪ সদস্যের কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। চামড়ার সরবরাহ চেইন সচল রাখতে খোলা হয়েছে একটি কন্ট্রোল রুম। পাশাপাশি চামড়ার গুণগত মান ঠিক রাখতে বিভাগওয়ারী মনিটরিং টিম, সমন্বয় কমিটিসহ ৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে চামড়া রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। এরমধ্যে প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা হলো ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার। একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রথম ১১ মাসের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বেশি আয় হয়েছে। অবশ্য গত অর্থবছরে এ খাত থেকে মোট রপ্তানি আয় হয় ১২ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
যদিও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার অবস্থান ভালো নয়। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি ডলার ইউনিট হিসাবে রপ্তানি আয় বেড়েছে। দেশে প্রায় দুবছরেরও বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে। এর মধ্যে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়। এমন অবস্থায় ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে ৮ মে ব্যাংকগুলোকে ১১৭ টাকায় মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সুফল অনেকটাই চামড়া রপ্তানি খাতে পড়েছে।
সে পরিস্থিতি বিবেচনায় আসন্ন কুরবানির পশুর চামড়ার মধ্যে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫-৬০ টাকা এবং মফস্বলের ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যা গত বছরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বেশি। গত বছর ঢাকার গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫-৪৮ টাকা। খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২০-২৫ টাকা এবং বকরি ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১২-১৪ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ইলিয়াছুর রহমান (বাবলু) যুগান্তরকে জানান, সরকার যে কাঁচা চামড়ার মূল্য ঘোষণা করেছে সেটি অনেক বেশি। বিদেশে এক বর্গফুট চামড়ার রপ্তানি মূল্য ৬০ টাকা। এখন কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া শেষ করে রপ্তানিযোগ্য করে তুলতে ব্যয় হবে ৯০ টাকা। তিনি আরও বলেন, অনেকে কেমিক্যাল বন্ড সুবিধা এনে খোলা বাজারে বিক্রি করছেন। এ সুবিধা বন্ধ করে ১০ শতাংশ কর আরোপ করে চামড়ার কেমিক্যাল আমদানি সবার জন্য করে দিলে লোকসানের ঘাটতি কিছুটা মোকাবিলা করা যাবে।
জানা গেছে, সারা বছরের পশুর চামড়ার মোট সংগ্রহের ৫০ শতাংশ আসে কুরবানির ঈদ থেকে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ বছর সোয়া কোটি পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে কুরবানি দেওয়ার মতো ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭ পশু প্রস্তুত আছে। যার মধ্যে গরু ৫২ লাখ। এসব চামড়া সংগ্রহ করবে ট্যানারি শিল্পের মালিকরা।
তবে বিপুলসংখ্যক এ চামড়ার মধ্যে একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের শঙ্কা থাকে। তবে ট্যানারির মালিকরা মনে করছেন সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হলে এ পাচার ঠেকানো সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চামড়া পাচার হতে পারে এমন ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ রুট অনেক আগ থেকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্ত পথে ১২টি এবং রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশ এলাকায় সাতটি।এসব নিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখান থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, চামড়া পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত রুটের তালিকার মধ্যে রয়েছে- বেনাপোল, সাতক্ষীরা, কলারোয়া, জীবননগর, মেহেরপুর, দর্শনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, জাফলং, তামাবিল, করিমগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন সীমান্তপথ।
এছাড়া যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাটকলঘাট, কালীগঞ্জ, নড়াইল ও রাজারহাট এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে বেনাপোল, কলারোয়া ও সাতক্ষীরা সীমান্ত। এখানে চামড়ার বড় হাট বসে যশোর রাজারহাটে। বছরের সাধারণ সময়ে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে পশুর চামড়ার হাট বসে। আর কুরবানির সময় আশপাশ অঞ্চলের চামড়া এ হাটেই কেনাবেচা হয়। ফলে এই সীমান্তগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
এছাড়া ঝিনাইদহ, মাগুড়া, শৈলকুপা, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরের চামড়া পাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে জীবননগর সীমান্ত দিয়ে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত পথ দিয়ে পাচার হয় নাটোর হাটের চামড়া। দেশের চামড়ার মোট চাহিদার ২৫ শতাংশ আসে দ্বিতীয় বৃহত্তম নাটোরের চকবৈদ্যনাথ চামড়ার আড়ত থেকে। প্রতি শুক্র ও শনিবার এই হাটে চামড়া বেচাকেনা হয়। ইতোমধ্যে কুরবানিকে সামনে রেখে আড়ত ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চামড়ার মান ভালো বলে অধিকাংশ ট্যানারির মালিকদের চোখ থাকে এই বাজারের দিকে। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচার সহজ বলে নজর থাকে পাচারকারীদেরও।
সূত্র আরও জানায়- চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, আল্লাহ দরগা, দৌলতপুর ও আলমডাঙ্গার চামড়া পাচারের রুট হচ্ছে মেহেরপুর ও দর্শনা সীমান্ত পয়েন্ট। এই দুটি পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের চামড়া পাচারের জন্য জাফলং, তামাবিল ও করিমগঞ্জ সীমান্ত পথকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে শনাক্ত করা হয়। আর দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে চামড়া পাচারের আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশ এলাকায় বিপুলসংখ্যক পশু জবাই হয় কুরবানির। ঢাকার চামড়া পাচার করতে সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে সেগুলো নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে তারা সাতটি রুট ব্যবহার করেন। এগুলো হচ্ছে- সাভার, গাজীপুর চৌরাস্তা, কাঁচপুর ব্রিজ, আশুলিয়া, বুড়িগঙ্গা ব্রিজ ১-২ ও সিংগাইর ব্রিজ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান যুগান্তরকে বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ বছর চামড়ার মূল্য কিছুটা সরকার বাড়িয়েছে। এখন মৌসুমি ক্রেতারা কিছুটা হলেও উৎসাহ পাবেন। তিনি আরও বলেন, পাচার প্রতিরোধে সীমান্ত এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে আমি জেনেছি। তার মতে এ বছর এক কোটি থেকে সোয়া কোটি পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, চামড়া পাচার রোধে ঈদুল আজহার দিন থেকে পরবর্তী ৭ দিন পর্যন্ত ঢাকা থেকে চামড়া ভর্তি ট্রাক ঢাকার বাইরে না যেতে পারে সেজন্য চিহ্নিত পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলসহ ৫টি পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন : কুরবানির পশুর চামড়ার বাজার পর্যবেক্ষণে মনিটরিং সেলসহ ৫টি তদারকি কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব কমিটি চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহণসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তদারকি করবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষকে প্রধান সমন্বয়ক করে একটি কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুত পরিস্থিতি ক্রয়, বিক্রয়সহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সার্বিক সমন্বয় ও তদারকি করবে। অন্যান্য কমিটি জেলা এবং পোস্তার চামড়া বাজার পর্যবেক্ষণে থাকবে।