Logo
Logo
×

অন্যান্য

বিআইডিএসর সম্মেলন

আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তাগিদ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:২৪ পিএম

আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তাগিদ

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, পরিবতর্নশীল ভূ-রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের হিসাব-নিকাশও ক্রমশ জটিল হচ্ছে। পাশাপাশি জনসমর্থনপুষ্ট শাসন ব্যবস্থা না থাকার কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিদেশি শক্তি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অন্যায়-অন্যায্য চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো চ্যালেঞ্জে পড়েছে। অথচ এটি নিশ্চিত করা গেলে, দেশের বৈদেশিক অর্থনীতির সঙ্গে সরকারের রাজনীতির স্বার্থের সমন্বয় করা সম্ভব। 

শনিবার গুলশানের লেকশোর হোটেলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের তিন দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের শেষ দিনে পাবলিক লেকচারে তিনি এসব কথা বলেন। 

এ সময় সভাপতিত্ব করেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার। এছাড়া দিনব্যাপী বিভিন্ন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এসব অধিবেশনে আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমানো, অর্থপাচার বন্ধসহ ব্যাংকিং খাতের কার্যকর সংস্কার দরকার বলে মতপ্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা বিনিময় হার এবং খেলাপি ঋণকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছে বলে উল্লে­খ করা হয়। 

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহারের প্রভাব চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলাফল দৃশ্যমান হয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে যে বৃহৎ আকারের সংঘাতে অর্থনৈতিক সরঞ্জামগুলোর এই ধরনের ব্যবহারের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কতটা বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। পরিবতর্নশীল ভূ-রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপি আন্তঃদেশীয় সর্ম্পকের হিসাব-নিকাশও ক্রমশ জটিল হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোকেও এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে ঝুঁকিও আছে আবার লাভবান হওয়ার সুযোগও আছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে বাণিজ্য বাড়াতে হলে, উচ্চ কর প্রবণতা কমাতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশপাশি রপ্তানিতে এতদিন যেসব প্রণোদনা দিয়ে আসছে সরকার, তা আমদানির ক্ষেত্রেও বাড়াতে হবে।

ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রভাবের তুলনায়, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ কম দৃশ্যমান হতে পারে। তবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এটি সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ, বিনিয়োগে বিধিনিষেধ, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং শুল্কের কাঠামো বিশ্বের এই দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির রপ্তানি এবং জিডিপিতে সরাসরি স্বল্পমেয়াদি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু অন্য দেশগুলো তাদের নিজস্ব রপ্তানির দুর্বল চাহিদার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি লক্ষণীয় যে, বাণিজ্য যুদ্ধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একে অপরের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসাবে রয়ে গেছে। এটিও সত্য, কিছু উন্নয়নশীল দেশ মার্কিন বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে চীন থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নিতে পারে। দক্ষতা এবং বিনিয়োগের অনুকূল আবহাওয়া, উদাহরণস্বরূপ- ভিয়েতনাম এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে বলে মনে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে (যা ২০১৮ সালের মাঝামাঝি শুরু হয়) দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ পণ্যের ধরন এবং তাদের প্রযুক্তি-উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন মাত্রায় উপকৃত হয়েছে। এটাও দেখা যাচ্ছে যে, শীতল যুদ্ধের সময়ের তুলনায় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি এখন অনেক বেশি পরস্পর নির্ভরশীল।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার উপস্থাপনা বাংলাদেশকেন্দ্রিক নয়। পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-অর্থনীতি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে এবং এসব দেশ যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে, তার ওপর তিনি আলোকপাত করেছেন।

বিকালে অনুষ্ঠিত হয় প্যানেল আলোচনা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।  বক্তব্য রাখেন- বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি  ঘোষ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাবেক সিনিয়র সচিব শরিফা খান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট হাবিবুর রহমান, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান প্রমুখ। 

ড. শামসুল আলম আলম বলেন, জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় কম এটা বড় সমস্যা। এই কম রাজস্ব আদায় নিয়ে ঋণ মান উন্নয়ন কঠিন। কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা এখনো পুরোনো ধ্যানধারণায় আছি। দাম বাড়লেই গোডাউনে ও চালের মিলে হানা দেই। এটা ঠিক নয়। কেননা বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদার চেয়ে জোগান কম হলেই দাম বাড়বে। এটা স্বাভাবিক। সরকার যদি আমদানি করেই তাহলে দাম বাড়ার শুরুতেই কেন করা হয় না। আমদানির অনুমতি দিলেই তো বাজারে জোগান বাড়লে দাম কমে আসবে। আর্থিক সংকট সমাধানে আগামীতে যিনি অর্থমন্ত্রী হবেন তিনি যেন একটি উপদেষ্টা পরিষদ রাখেন। স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে ওই কমিটি যে কোনো সমস্যায় পরামর্শ দিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ইতোমধ্যেই পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছেন। দক্ষতার অভাবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ানো যায় না।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হবে না। তবে যতটা সম্ভব বাজারভিত্তিক করা হবে। সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে তা নিয়ে দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা বিনিময় হার এবং খেলাপি ঋণ কমানো। এ তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। ইতোমধ্যেই ১০-১১টি বৈঠক করেছি। এসব সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক শক্ত অঙ্গীকার আছে। সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর অ্যাক্ট করেছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আমাদের দেশের সংস্কৃতি হলো মানুষ মনে করে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে হবে না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যেটা করছি তা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ হারের ক্যাপ তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে গত ৫ মাসে আড়াই শতাংশ সুদহার বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পলিসি সাপোর্ট দিচ্ছি। স্প্রেড বাড়িয়েছি। সঞ্চয়ের কোনো সীমা নেই। ল্যান্ডিং রেট ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা ব্যাংকের ভল্টে ঢুকাচ্ছে। টাকার মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। টাকা ছাপানো হচ্ছে না। ফলে গত মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে। ডিসেম্বর মাসে আরও কমে ৯ শতাংশের নিচে অর্থাৎ ৮ শতাংশের মধ্যে আসবে। 

বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তারা বলেন, ক্রমবর্ধমান জটিল বৈশ্বিক ব্যবস্থার  পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে অর্থনৈতিক কূটনীতি পরিচালনা করা যায়, যাতে শিল্পোন্নত পশ্চিম এবং উদীয়মান চীন ব্লকের মধ্যে একটি উপযুক্ত ভারসাম্য বজায় রাখা যায়, যা এখন রাশিয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম