যুগান্তর-এভারকেয়ার হাসপাতালের বৈঠক
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২৩ পিএম
দেশে স্তন ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শেষ পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্ত হওয়ায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীরা নিঃস্ব হচ্ছেন। ব্যয় মেটাতে না পেরে অনেকে মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেন। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে ৯০ শতাংশ স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্তন ক্যানসার সম্পর্কে নারীদের মধ্যে ভীতি কাটানোর পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার এভারকেয়ার হাসপাতালের (ঢাকা) উদ্যোগে যুগান্তর কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ কথা বলেন। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন যুগান্তরে স্বাস্থ্য পাতা সম্পাদক ডা. ফাহিম আহমেদ রুপম।
বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হসপিটাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হোমের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ হাই। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মধ্যে স্তন ক্যানসার অন্যতম। কিন্তু রোগটি সম্পর্কে অনেকের ধারণা কম, প্রাথমিকে শনাক্তকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক নারী জানেন না। রোগটি এখন যে কোনো জায়গা থেকেই স্ক্রিনিং করা সম্ভব। দেশে স্তন ক্যানসার কেন বাড়ছে, এর ঝুঁকি ও কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন জরুরি। ক্যানসার রোধে জীবনাচার পরিবর্তন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, তামাকপণ্য বর্জন ও ধর্মীয় রীতি মানা জরুরি। কিন্তু দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার রোগী শনাক্ত সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, কিছু আচরণের জন্য অনেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে ধূমপায়ীদের মাধ্যমে স্তন ক্যানসার ছড়াতে পারে। তাই নারীর পাশাপাশি পুরুষেরও সচেতনতা দরকার। গত দুই মাসে আমরা ১৪০০ নারীকে স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করেছি। বাংলাদেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, সেখানে গিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি মেশিনের স্বল্পতা রয়েছে, এভারকেয়ার হাসপাতাল ক্যানসার সোসাইটির পাঠানো সব রোগীকে ৩০ শতাংশ সাশ্রয়ী মূল্যে রেডিওথেরাপির দিচ্ছে। ক্যানসার সচেতনতায় গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।
মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও শান্তি ক্যানসার ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. পারভিন শাহিদা আক্তার বলেন, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১৬ বছরে ১০ হাজার স্তন ক্যানসার রোগীর তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করা হয়েছে। তথ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ রোগীর বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর। ২৫ শতাংশ রোগী ৪০ বছরের নিচে। ৫ শতাংশ রোগী ৩০ বছরের নিচে। অথচ উন্নত দেশে ৫০ বছর বয়স থেকে স্তন ক্যানসার শুরু হয়। আমাদের দেশে গড়ে ৪৫ বছরের মধ্যে ক্যানসারের রোগী দেখা যায়। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ রোগীর অতিরিক্ত ওজন।
এভারকেয়ার হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের রেডিয়েশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল অনকোলজি কো-অর্ডিনেটর ডা. বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। দেশে এ চিকিৎসায় অনেক সেন্টারে অত্যাধুনিক সরঞ্জামের ব্যবহার হচ্ছে। রোগীদের থেরাপি দেওয়ার সময় স্কিন রিঅ্যাকশনের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সেটি শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জুনিয়র চিকিৎসকরাও অভিজ্ঞ হয়ে উঠছেন। স্তন ক্যানসারসহ যে কোনো ধরনের ক্যানসারে রেডিওথেরাপি চিকিৎসায় আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন।
একই বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেটর ডা. ফেরদৌস শাহরিয়ার সৈয়দ বলেন, দেশে ৯০ শতাংশ ক্যানসারের ওষুধ তৈরি হয়। বিদেশের ওষুধের সঙ্গে এগুলোর দামে প্রার্থক্য হলেও গুণগত মানে পার্থক্য নেই। তবে ইমিউনোথেরাপির মতো কিছু ওষুধের পার্থক্য আছে। কেমোথেরাপি, টার্গেটেট থেরাপি, হরমোনাল থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি- সবই দেশে আছে। মেডিকেল অনকোলজিস্টরা এসব চিকিৎসা দিচ্ছেন। তারা রোগীদের কষ্ট প্রশমনে সিম্পোটিক ও সাপোর্টিভ চিকিৎসাও দিচ্ছেন। যখন রোগীর রোগ নির্ণয় হয়, তখন এফএনসির পরিবর্তে বায়োপসি বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
রেডিও অনকোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, যে কোনো ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ গুরুত্বপূর্ণ। এতে কোন রোগীর জন্য কী চিকিৎসা প্রয়োজন, কোনটা আগে এবং কোনটা পরে শুরু হবে, চিকিৎসা করাতে গিয়ে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেগুলো আগে চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা করা। এরপর রোগীর স্বজনদের সঙ্গে শেয়ার করা। এতে তাদের মধ্যে ভীতি দূর হয়। চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। তাছাড়া একজন রোগীর ক্যানসার চিকিৎসায় কী কী করতে হবে, চিকিৎসকরা কী চিকিৎসা দেবেন, এটা জানার অধিকার রয়েছে। এ জায়গায় ঘাটতি থাকায় অনেক রোগী বাইরে চলে যাচ্ছেন। স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচের মধ্যে সার্জন, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও হিস্টোপ্যাথলোজিস্টসহ অন্যান্য স্পেশালিস্ট চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়ে। চিকিৎসকরা রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নিতে রাজি হন।
জেনারেল অ্যান্ড ল্যাপরোস্কোপি সার্জারি বিভাগের কো-অর্ডিনেটর ও সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. এসএম আবু জাফর বলেন, এভারকেয়ার হাসপাতালে প্রায় সব চিকিৎসকের কাছেই স্তন ক্যানসারের রোগী আসেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে ব্রেস্ট স্ক্রিনিং চালু করেছি। স্তন সমস্যাসংক্রান্ত রোগী এলে নারী সার্জিক্যাল স্পেশালিস্ট ও নারী অনকোলজিস্টের মাধ্যমে চেকআপ করানো হয়। স্নোগ্রাফি, ম্যামোগ্রাফিসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা হয়। কারও স্তনে ক্যানসার ধরা পড়লে স্টেজ বুঝে মেডিকেল বোর্ড করে মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. পি কে সাহা বলেন, ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার চেয়ে বেশি মৃত্যুভয় কাজ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।
সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মাদ ফরিদ হোসাইন বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ভারতে প্রতি ১৬ জন নারী এ সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ৬০ বছরের বেশি নারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বে প্রতি ১৩ সেকেন্ডে একজন করে নারী ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসায় রোগীর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হচ্ছেন। ফলে স্তন ক্যানসার নিয়ে নারী-পুরুষ সবারই সচেতনতা দরকার।
চিফ মার্কেটিং অফিসার ভিনয় কাউল বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে বিশ্বমানের মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়ার প্রতিশ্রতি নিয়ে এভারকেয়ার হাসপাতাল কাজ করছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতালের মাধ্যমে ক্যানসারসহ অন্য রোগীদের সেবায় সেরা রেডিওলোজিস্ট ও অনকোলোজিস্ট চিকিৎসক রয়েছেন। বাংলাদেশে নারীরা স্তন ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের এখানে যেসব রোগী আসছেন, তাদের বিশ্বমানের সেবা দিচ্ছি। ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সামাজিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। স্তন ক্যানসার সচেতনতায় যুগান্তর আমাদের সঙ্গে কাজ করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
জোনটা ক্লাব (ঢাকা) সভাপতি এবং সমাজকর্মী নিলুফার রহমান বলেন, আগামী দিনে এ রোগটি মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ দশমিক ৭ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২১ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যেটি ২০০৫ সালের দিকে ৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩ শতাংশ হতে পারে পারে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে হবে।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন যুগান্তরের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (বিজ্ঞাপন) আবুল খায়ের চৌধুরী। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এভারকেয়ার হাসপাতালের বিজনেস ডেভেলপমেন্টের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ইথিয়া হাসান অহনা, মার্কেটিং ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার ড. মো. রাশেদ আল রাজী, ডেপুটি ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) ইমনুল হক, অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) এসএম জাফরুল ইসলাম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) রাজীব আচার্য, সিনিয়র অফিসার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) মো. আতিকুর রহমান, যুগান্তরের প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে কয়েকজন অতিথিকে ক্রেস্ট ও সম্মাননা দেওয়া হয়।