
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৩৮ এএম

আখতারুন নাহার আলো
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
বৈশাখের প্রথম দিনটি বাঙালির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিন বাঙালিরা সাধ্যমতো নতুন পোশাক ও বাঙালি খাবার খেতে পছন্দ করেন। খাবারের দিক থেকে শিকড়ের কাছে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
রমনার আশপাশে ও বিভিন্ন জায়গায় মুড়িমুড়কি বাতাসার পাশাপাশি পান্তা ভাতের টং দোকান দেখতে পাওয়া যায়। বাড়িতেও অনেকে এ ধরনের খাবারের আয়োজন করে থাকেন। পান্তা ভাত আমাদের দেশে প্রায় অনাদৃত খাবারের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু নববর্ষের প্রথম দিনটিতে সবাই পান্তা ভাত খেতে পছন্দ করেন। রাতে রান্না করা ভাত ঠান্ডা করে পানিতে ভিজিয়ে রাখলেই সেটা হবে সকালের পান্তা ভাত। রান্নার কোনো ঝামেলা নেই।
যুগ যুগ ধরে বাংলার কৃষকদের এ ভাত বেশ সমাদৃত। তারা খেতে কাজ করার আগে এক থালা পান্তা খেয়েই দিনের কাজ শুরু করে। পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণের কথা বর্তমান গবেষণায় বেশ প্রচারিত হচ্ছে। এটি জলীয় খাবার বলে বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে শরীরকে ঠান্ডা রাখে। শর্করাসমৃদ্ধ বলে কাজ করার শক্তি জোগায়। এতে ল্যাক্টোব্যাসিলাস নামক একটি উপকারী ব্যাকটেরিয়া দেখা যায়। যেটা ফাইটেট তৈরিতে সাহায্য করে। ফাইটেট ভেঙে এর পুষ্টিগুণ অনেক খানি বেড়ে যায় বলে এটি হজমে সহায়ক। পেট ফাঁপা কমায়। এতে লৌহ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম সন্তোষজনক মাত্রায় থাকে।
ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এ মাছ অনেকের নাগালের মধ্যে নেই। তারপরও কেউ যদি শখ করে খেতে চান পুষ্টির দিক দিয়ে শরীরে ভালো প্রভাব ফেলে। কারণ ভিটামিন ‘ই’ সমৃদ্ধ এ মাছ ওমেগা ও ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস। এতে আছে অসম্পৃক্ত চর্বি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ও ভিটামিন ‘এ’। হৃদরোগীদের জন্য এ মাছ খুবই ভালো। এটি ভালো কোলেস্টেরল অর্থাৎ এইচডিএল বাড়াতে সাহায্য করে। যদি ইলিশ মাছ জোগাড় করতে না পারেন, তাহলে যে কোনো ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত খেতে পারেন। বাঙালিদের ভর্তা পুষ্টিগুণে ভরপুর। বিশেষ করে শুঁটকি-মরিচ-ধনিয়াপাতা ভর্তা, কাঁচামরিচ-মাছ-আলু ভর্তা ইত্যাদি। যে কোনো ভর্তাই স্বাদযুক্ত ও পুষ্টিকর।
ইলিশ মাছ ছাড়াও শুঁটকি ভুনা দিয়ে পান্তা খেলে মন্দ হয় না। তবে পান্তা ভাত খাওয়ার আগে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যদি দূষিত পানি দিয়ে ভাত ভেজান হয় তাহলে ডায়রিয়া, বমি, আমাশয় ইত্যাদি হতে পারে। যদি বাইরের পান্তা খান সেটি যে পাত্রে দেওয়া হচ্ছে, যে প্লেটে দেওয়া হচ্ছে সেটার দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। অনেক সময় বেশি মুনাফা লাভের আশায় দোকানিরা অন্য মাছকে ইলিশ বলে চালিয়ে দিতে পারেন। আমাদের শহুরে তরুণ সমাজ অনেকেই বাড়িতে মাছ খান না। তাই তারা সহজেই প্রতারিত হতে পারেন। কারণ, মাছ ভালোভাবে চিনতে পারেন না। যারা বাড়িতে পান্তা খেতে চান তারা রাতের রান্না করা ভাত ফুটান পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখবেন। সকালে সেই ভাত কয়েকবার ধুয়ে নেবেন। কারণ ভাতের পানিতে যদি ফেনা জমে সেই ভাত না ধুয়ে খেলে পেটে গ্যাস হতে পারে।
নববর্ষের প্রথম দিন সকালের নাশতায় ফল খেতে পারেন। এটি যেমন উপাদেয়-তেমনি পুষ্টিসম্মত। এতে থাকবে ভিজান চিড়া-মুড়ি, পাকা কলা, নারিকেল, টক বা মিষ্টি দই, গুড়। এর সঙ্গে যদি একটি রসগোল্লা অথবা সন্দেস মাখাতে পারেন তবে আরও ভালো হয়। যদি মিষ্টি দই মিশান হয় সেক্ষেত্রে এক টুকরা সুগন্ধি লেবুর রস মিশাতে পারেন। পান্তা ভাত অথবা দই-চিড়া যাই খান না কেন, সেটা যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
* সঠিক উপায়ে যেভাবে পান্তা বানাবেন
▶ অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের বদলে অবশ্যই মাটির খোরা বা বাসন ব্যবহার করবেন। অ্যালুমিনিয়াম-প্লাস্টিক দূষণের উৎস। পাশাপাশি মাটির বাসন পান্তার তাপমাত্রা লম্বা সময় ধরে একই রকম রাখবে।
▶ পান্তার পানির তাপমাত্রা ২৪-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ভালো। ২৮ ডিগ্রির ওপরে পানি যত গরম হবে, পান্তা তত দ্রুত নষ্ট হবে। ২২ ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রার পানিতে পান্তা আবার শক্ত হয়ে যেতে পারে।
▶ পান্তা দেওয়ার আগে ভাত বেশি নরম করে রান্না করা যাবে না এবং রান্নার পর ঠান্ডা হতে অন্তত ২ ঘণ্টা সময় দিতে হবে।
▶ পান্তা দেওয়ার পর ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় তা রেখে দিতে হবে যথাসম্ভব ঠান্ডা জায়গায়।
* কখন ও কীভাবে পান্তা বানাবেন
▶ বাসন থেকে তুলে ফেলার পর রেখে না দিয়ে দ্রুত পান্তা খেয়ে ফেলতে হবে। খাওয়ার ক্ষেত্রে শুকনো মরিচের চেয়ে কাচা মরিচ পেটের জন্য বেশি ভালো হবে।
▶ আলুভর্তা দিয়ে পান্তা খাওয়া খুব একটা স্বাস্থ্যকর কিছু নয়। সাদা চালের পান্তা কোনো পুষ্টিকর খাবার নয়। বাদামি চালের পান্তায় যথেষ্ট পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়, বিশেষভাবে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ফসফেট।
▶ যাদের রুচি কম তারা পান্তায় লেবুর রস ব্যবহার করতে পারেন, রুচি বাড়তে কাজে দেবে।
▶ যাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিশেষ করে পেটে চর্বি আছে, তাদের পান্তা না খাওয়াই ভাল।
▶ যাদের ওজন কম বা স্বাভাবিক, দিনে একবেলা নির্ভয়ে পান্তা খেতে পারেন। আইসক্রিমের চেয়ে পান্তা দেহের তাপমাত্রা শীতল রাখতে বেশি কার্যকর। আইসক্রিমে সুগার থাকে।
পান্তা রুচি ও ওজন দুটোই বাড়াতে সহায়তা করে। পান্তা খেলে প্রথমে একটু ঘুম ঘুম ভাব আসে আবার বাড়তি এনার্জিও পাওয়া যায়। ঘুম আসে মূলত অ্যালকোহলিক কম্পাউন্ডের জন্য। পান্তায় প্রায় ০.৫ থেকে ১.৫ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে। আর এনার্জি বুস্ট হয় ডাইজেস্টিভ এনজাইম-মাইক্রোমিনারেলের জন্য।
লেখক : চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.), বারডেম। সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।