
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০৭ এএম
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১০:২৭ পিএম

‘রাত তখন দুইটা। চেষ্টা করছিলাম চোখের পাতাগুলো এক করতে। কেমন যেন অস্থির লাগছিল। মনে হচ্ছিল ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎই চারটি বিস্ফোরণে আমার বাড়ি কেঁপে উঠল। লাল হয়ে গেল আকাশ, ধোঁয়ায় কেঁপে উঠল চারপাশ। মাথার উপর ড্রোন, কোয়াডকপ্টার, হেলিকপ্টার, এফ-১৬ ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান চক্কর দিচ্ছিল। এর পরই শোনা গেল বিকট বিস্ফোরণ’- মধ্যরাতে গাজায় সেই ইসরাইলি বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছেন দেইর আল বালাহর সাংবাদিক আবু বকর। অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রথম ধাপ পেরুতে না পেরুতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইশারায় ১৮ মার্চ ঘুমন্ত গাজাবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাইল। শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এক দিনেই প্রাণ হায় ৪৩৪ জন অসহায় মানুষ। এপি, ইন্টারনেট।
সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করে আবু বাকর বলেন, দূর থেকে ভেসে আসছিল মায়েদের কান্না এবং বাচ্চাদের চিৎকার। আমাকে সেই আওয়াজগুলো বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি আমার হাঁটু অসাড় হয়ে গিয়েছিল। আমার মা নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। ভেবেছিলাম এটাই হয়তো আমাদের শেষ দিন।
মঙ্গলবারের দিন শেষে মধ্য গাজার আল নুসিরাত ক্যাম্পের আল আওদা হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ জরুরি চিকিৎসক ডা. আব্দুল কাদের ওয়েশাহ হাসপাতালের পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আশপাশের হামলার পর আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা আরও বেশি হতাহতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছি। কারণ আরও বোমা হামলা হওয়ার প্রত্যাশিত।
ওয়েশাহ আরও বলেন, চিকিৎসা সরবরাহের অভাবের কারণে কিছু আহতকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়েছে। আমাদের কোনো উপায় নেই। গাজার হাসপাতালগুলো সব কিছু থেকেই বঞ্চিত। এখানে হাসপাতালে, জীবাণুনাশক এবং গজের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোসহ আমাদের সবকিছুর অভাব রয়েছে। আমাদের কাছে হতাহতদের জন্য পর্যাপ্ত শয্যা নেই। আহতদের চিকিৎসা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এক্স-রে ডিভাইস, ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং এবং হাসপাতালের সেলাইয়ের মতো সাধারণ জিনিস পাওয়া যায় না। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি।
গাজার আল শিফা হাসপাতালের পরিচালক মুহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেছেন, ‘প্রতি মিনিটে একজন আহত ব্যক্তি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে মারা যায়।’ গাজার রিপোর্টার আবু বকর আরও বলেন, ‘ইসরাইল নতুন হামলায় অন্তত ছয়টি পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করেছে। একটি আমার শহরে। অন্যরা খান ইউনিস, রাফাহ এবং গাজা সিটির। কিছু পরিবার পাঁচ বা দশজন সদস্যকে হারিয়েছে। অন্যরা প্রায় ২০ জন হারিয়েছে।’
রাফাহতে একটি পরিবারে বোমা হামলা হয়েছে। হামলায় বাবা ও তার দুই মেয়ে নিহত হয়েছে। তাদের মা এবং দাদা-দাদিসহ তাদের চাচা-চাচিকেও হত্যা করা হয়েছে। মোটামুটি পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। মূলত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় গাজায়।
প্রথম ধাপের এই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ ১ মার্চ শেষ হয়। দ্বিতীয় ধাপের বিষয়ে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে ইসরাইল হামাসের কাছে সব জিম্মি মুক্তির নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। এর পরই মার্কিন মদদে গাজায় শুরু হয় ইসরাইলি হামলা। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট ফক্স নিউজে বলেছেন, ‘যারা শুধু ইসরাইল নয়, যুক্তরাষ্ট্রকেও সন্ত্রাসবাদ করতে চায়, তাদের মূল্য দিতে হবে। সব নরক ভেঙে পড়বে।’
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের জন্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী মুহান্নাদ হাদি বলেছেন, ‘এটি অযৌক্তিক। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি পুনর্বহাল করতে হবে। গাজার মানুষ অকল্পনীয় দুর্ভোগ সহ্য করেছে। গাজার হাসপাতালের সংকটকে আরও জটিল করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু আমরা সবাই একই ঘরে বসেছিলাম, গোলাগুলি কখনোই থামেনি। একটানা গোলাগুলি ছিল ভয়ংকর। প্লেন এবং ট্যাংকগুলো গুলি চালানো বন্ধ করেনি। ড্রোনের গুঞ্জন তীব্র হয়ে ওঠে। এটি একটি নারকীয় দৃশ্য ছিল। এটি এখন পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকে এবং এটি থামেনি।’
এদিকে যুদ্ধবিরতি সময়ও গাজায় নানারকম সহায়তা সরবরাহে বাধা প্রদান করছিল বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার। চুক্তির প্রথম ৪২-দিনে খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ অনুমতি দেওয়া হলেও বসবাসের জন্য ৬০,০০০ মোবাইল হোম এবং ২০০,০০০ তাঁবু প্রবেশে অস্বীকৃতি দিয়েছিল ইসরাইল।
এরপর ২ মার্চ থেকে খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ৯ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহও। পানি পৌঁছাতে বাধা দেওয়ায় দেইর আল বালাহ এবং খান ইউনিসে ৬০০,০০০ জন মানুষ খাবার পানির অভাবে ভুগছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপর থেকে অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে শুরু হয় ইসরাইলের ‘অন্তহীন’ আগ্রাসন।
ঘটনাপ্রবাহ: হামাস ইসরাইল যুদ্ধ
আরও পড়ুন