Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

হামিদ সাহেবের রিটায়ারমেন্ট

Icon

সালেহ উদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হামিদ সাহেবের রিটায়ারমেন্ট

হামিদ সাহেবের ত্রিশ বছরের চাকরি জীবন শেষ হলো অবসর গ্রহণের মাধ্যমে। একটু আগেভাগেই অফিস ছুটি আজ, বাড়ি ফিরে আসার পথে মনে নানা রকম অনুভূতি। আগামীকাল থেকে অফিস যেতে হবে না, প্রতি দিনই ছুটি। বাসের যাতায়াত, রিকশায় এত বড় শরীরটার ভারসাম্য রাখার ঝামেলা এসব পোহাতে হবে না। সকালবেলা লম্বা ঘুম। খারাপ দিকও আছে, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো মাস শেষে বেতন আসবে না ব্যাংকে।

গিন্নির সঙ্গে কথা হয়েছে, সে বেশ সাহস দিয়েছে, দুজন তো মাত্র লোক, যা পেনশন আর সামান্য সঞ্চয়, তাতেই চলে যাবে। বাড়ি ভাড়া তো নেই। অবশ্য ঘরগুলোকে দালান করা আর হয়তো কোনোদিনই হবে না। না হোক দালান। দুটা টিনের ঘর, ও হা ছোট ঘরটা তো ভাড়াতে। সেখান থেকেও সামান্য কিছু টাকা আসে। অসুবিধা হয়তো হবে না।

হামিদ-রাইমা পরিবারে কোনো সন্তান নেই। তা নিয়ে রাইমার মনোকষ্ট আছে, কিন্তু কোনো মন-বীমার নেই। বরং রাইমাই হামিদ সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে আসছে, সৃষ্টিকর্তা চাননি, তাই দেননি।

বাড়ির ফটকে এসে রিকশা থেকে নামলেন, হামিদ সাহেবের কেমন অস্বস্তি হলো, দরজা পর্যন্ত এসে অস্বস্তিটা আরও বাড়ল। বাঁ হাতে অফিসের ব্যাগ, ডান হাতে সহকর্মীদের দেওয়া কিছু গিফট। গিফটের পোঁটলাটা মাটিতে রেখে, আস্তে করে দরজাটা চাবি দিয়ে খুলে ঘরে ঢুকলেন হামিদ সাহেব।

রাইমা হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে। দুপুরে ওর নিদ্রার অভ্যাসটা কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যায়নি, এখন হামিদ সাহেব বলা ছেড়েই দিয়েছেন। কিংবা রাইমা আজ হয়তো ঘুমাবে না, ঘণ্টাখানিক আগেই ফোনে কথা হয়েছে। হয়তো মুখ গুমরে ঘরের এক কোণে বসে রয়েছে। স্বামীর অবসরে যাওয়া মেয়েদের কাছে কম বিড়ম্বনার নয়!

দরজা খুলে ঢুকতেই হামিদ সাহেব হোঁচট খেলেন। রাইমা যে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে, সেটা ছিল তার চিন্তার বাইরে, হয়তো জানালা দিয়ে দেখেছে। আরও আশ্চর্য হয়েছেন রাইমার সাজ দেখে, আর রাইমা যেভাবে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছে তা এ বয়েসে সবার সামনে না বলাই ভালো। খুব ভালো লাগল হামিদ সাহেবের।

তেমন বেশি কিছু কথা হলো না রাইমার সঙ্গে। হামিদ সাহেব গিফটের পোঁটলাটা রাইমার হাতে দিয়ে চলে গেলেন হাতমুখ ধুতে। রাইমা পুলিপিঠা বানিয়ে রেখেছে, হামিদ সাহেবের খুব প্রিয় পিঠা। চা খেতে খেতে খেয়াল করলেন রাইমা বেশ হাসছে আবার যেন ক্ষণে ক্ষণে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে।

হামিদ সাহেবের কেমন যেন খটকা লাগল। রাইমা এত খাতির করছে কেন? রায়না কি কিছু একটা জানান দিচ্ছে যে, তিনি অবসর নিয়েছেন? আবার মাঝে মাঝে অন্যমনস্কওবা হচ্ছে কেন?

অবসরের তিন মাস পার হয়ে গেছে। হামিদ সাহেব ও রাইমার সংসার গতানুগতিক চলছে। জিনিসপত্রের দাম কেমন দিনদিন বাড়ছে। রাইমার বাজারের ফর্দ থেকে বেশ কিছু কাটছাঁট করে এখন বাজার করতে হয়। রাইমা কিছু বলে না। আগে মনে আছে, একটা জিনিস বাদ গেলে রাইমা একঘণ্টা জেরা করত আর রেগে তেলেবেগুনে জ্বলত।

রাইমার দুই খুব কাছের বন্ধু নিকটেই থাকে, আগে রাইমা টুক টুক হেঁটে বা রিকশা নিয়ে ওদের সঙ্গে গল্প করতে যেত। এখন হামিদ সাহেব লক্ষ করলেন রাইমা তেমন বাড়ির বাইরে যায় না, টেলিফোন করাও অনেক কমিয়ে ফেলেছে। রাইমার সঙ্গে হামিদ সাহেবের প্রয়োজনীয় কথাবাবার্তা ছাড়া তেমন কথাবার্তা হয় না, হামিদ সাহেবও ওকে তেমন বিরক্ত করেন না। আগে সময় করে দুজনে সিনেমায় যেতে না, রাইমা সিনেমা দেখার পাগল ছিল। এখন রাইমা যেতে চায় না। বলে,

- ‘কি দরকার পয়সা নষ্ট করে?’

অবসরের আগে রাইমা পয়সা কড়ি নিয়ে খুব খোঁচা দিত প্রায়ই। যেমন, ‘সবাইর বেতন বাড়ে, তোমার কেন বাড়েনা’ বা ‘হ্যাঁ গো, তোমার কি প্রমোশন জিন্দেগিতেও হবেন না!’ বা ‘তোমাদের গ্রামের জায়গাটা বেচে দাও, আমাদের ঘরটা একটু পাকাপোক্ত করা যাবে’। এই রকম, সব বউরা যেমন করে বলে। এখন রাইমা টাকা-কড়ির কথা একদম উঠায় না, হামিদ সাহেব কিছু বলতে গেলে ও বরং এড়িয়ে যায়। হয়তো ভাবে, ল্যাংড়া ঘোড়াকে চাবুক মেরে তো আর দৌড়ানো যাবে না বা অন্য কোনো কিছু।

রাইমা যেন কেমন হয়ে গেছে। সব কিছুতে কেমন চুপচাপ, অমনস্ক মানে হয় হামিদ সাহেবের কাছে। অথচ রাইমা ছিল খুব মুখর স্বভাবের। হামিদ সাহেবের মনে হয় রাইমা তাকে খুব অবজ্ঞা করে। মুখে কিছ বলে না, কিন্তু তার নীরবতা ও অনুভূতিহীনতা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু অবজ্ঞা যে ঠিক কোথায় সেটা নিয়ে অনেক ভেবেও হামিদ সাহেব কূলকিনারা করতে পারছেন না। এ যেন বউয়ের পরকীয়া প্রেম, হাতে হাতে ধরা যাচ্ছে না, কিন্তু সন্দেহটা মনে দারুণ বিঁধছে।

একদিন রাইমা এসে বললো,

-‘হা গো তুমি শুনছ, করিম ভাই নাসিরাবাদে একটা নতুন বাড়ি বানাচ্ছেন, লালখান বাজারের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে সামনে নতুন বাড়িতে উঠবে।’

রাইমা এমন কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি, শুধু টিভির খবরের মতো পড়ে গেছে সংবাদটা। হামিদ সাহেবের মনে হলো, কী প্রয়োজন তাকে বলার? আর যদিও রাইমার কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না, কিন্তু কেমন যেন একটা খোঁচানো সুর ছিল তার! সেই যাই হোক, হামিদ সাহেব খুশি দেখালেন। মুখে বললেন,

-‘করিম দুলাভাই দারুণ ভাগ্যবান লোক, প্রথম থেকে আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে কাজ করে ভালোই করেছেন। আমি কেন যে গ্ল্যাক্সর চাকরিটা না নিয়ে ঢাকাতে থেকে গেলাম!’

রাইমা কিছু বলল না, নিজ কাজে চলে গেল। করিম চৌধুরী রাইমার বড় বোনের স্বামী, হামিদ সাহেবের চেয়ে তিন বছরের মতো বড়। হামিদ সাহেব লোকটাকে একদম পছন্দ করেন না। লোকটা যেন প্রতি দুবছর পর পর প্রমোশন নিয়ে আকাশে উঠছে। নিচে পড়ার নাম নেই, অবসরের খবর নেই! সে যাই হোক, হামিদ সাহেবের খারাপ লাগছে, রাইমা কেন যে তাকে আগের মতো কোনো খোঁটা বা টিটকারি দেয়নি। অবজ্ঞার চেয়েও রাগ ঝাঁজই ভালো। সত্যি রাইমা কি তাকে অবজ্ঞা করে? - হামিদ সাহেব আবার ভাবলেন।

হামিদ সাহেবের খুব বেশি আশ্চর্য লাগে, অবসরের পর রাইমা তাকে কখনো আর একটা চাকরি খুঁজতে বলেনি। তার ধারণা ছিল অবসরের পরের দিনই ও বলবে,

- ‘হা গো দেখ না আর একটা চাকরি পাও কিনা।’

রাইমা তেমন কিছু বলেনি। চাকরি যে তিনি খুঁজছেন না তা নয়। ভাবছিলেন একটা নতুন চাকরির কাগজ এনে রাইমাকে চমকে দেবেন। কিন্তু চাকরির যে বাজার, ঘোরাঘুরি করে তিনি বুঝেছেন, যেখানে এত এত বড় বড় ডিগ্রি ধারি তরুণ-যুবকরা চাকরি পাচ্ছে না, সেখানে তার আশা একদম শূন্য। অবশ্য ভূতপূর্ব বসকে বলে রেখেছেন, কোনো সুযোগ হলে যেন তাকে একটু বিবেচনা করেন- পার্টটাইম, প্রজেক্টের কাজ, কিংবা অস্থায়ী কাজ।

হাল ছেড়েই দিয়েছিলেন। একদিন তার বড় সাহেবের একটা ফোন এলো। বস বললেন,

-‘হামিদ সাহেব, আপনাকে আমার প্রয়োজন। সরকারি একটা ফান্ড পেয়েছি একটা নতুন প্রজেক্টের জন্য। হিসেবে নিকেশে আপনি ভালো। ভাবছি অপরিচিত লোক না নিয়ে, আপনাকে দিয়ে চালিয়ে দেব, অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে। তবে এখন বেতন আগের চেয়ে একটু কম হবে। আপনি অফিস এলে এইসব কথা হবে।’

হামিদ সাহেবের হাত ও গলা দুটোই কাঁপছে। কোনো রকমে ফোনটাকে জাপটে ধরে, জিজ্ঞেস করলেন,

- ‘কবে আসবো স্যার?’

রাইমা সম্ভবত কাছে ছিল। তার মুখেও একটু হাসি দেখা দিল। হামিদ সাহেব ভাবলেন, রাইমা কী বলবে? হয়তো বলবে, বেতন কেন কম হবে? দশ ঘণ্টা খাটাবে, আবার বেতন কম! অথবা রাইমা কি সেদিনের মতো উষ্ণভাবে অভিনন্দন দেবে? না রাইমা তেমন কিছু করল না বা কিছুই বলল না, শুধু বলল,

- ‘খুব ভালো লাগছে, তোমার বসটা খুবই ভালো।’

রাতের খাওয়ার সময় বলল,

- ‘তোমাকে বড্ড মিস করব। এ কয় মাস সারা দিন কাছে থাকতে থাকতে কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে’।

হামিদ সাহেব ভাবলেন, রাইমা কি সত্যি সত্যি বলছে?

হামিদ সাহেবের প্রজেক্টের চাকরি রুটিন মাফিক চলতে থাকে। সে টিফিন ক্যরিয়ারের একই রকম গন্ধ, বাস রিকশার ঝক্কি আগের মতোই চলছে। রাইমা কি আগের তালে ফিরে আসছে? হামিদ সাহেব নিশ্চিত নন। তবে কিছু পরিবর্তন হয়েছে, বন্ধুদের বাসায় যায় মাঝেসাঝে।

একদিন অফিস থেকে ঘরে ফিরে দেখেন, ঘরে তুলকালাম কাণ্ড! রাইমার যত মেয়েলি স্বর্ণালংকার সব বিছানার ওপর ছড়ানো-ছিটানো। রাইমার সেই আগের মতোই চিৎকার,

- ‘হ্যাঁ গো, তোমার বড় সাহেব বলছিল কিছু দিন কাজ করলে, বেতন বাড়িয়ে আগের সমান করবে। সে কবে হবে? দিদিদের নতুন বাড়ির ছাদ ঢালাই হলো আজ। আমরা কি দুটা রুমও পাকা করতে পারব না?’

হামিদ সাহেব আশ্বস্ত করলেন,

- ‘কালকেই বসকে বলব, বেতন বারবার কথা।’

রাইমার রাগ থামল না। রাইমা বিছনার চাদর উলটিয়ে সব অলংকারগুলো ঘরের ফ্লোরে ফেলে দিল। আক্রোশ ঝেড়ে বলল,

- ‘এসব রেখে কী হবে? সব নিয়ে বেচে দাও, আর গ্রামের জায়গাগুলো ও। তুমি যে বেতন পাও, সব জমা থাকবে। আমাদের সংসার চলবে ঠিক তেমনভাবে, প্রজেক্টের চাকরি পাওয়ার আগে যেমন চলছিল। তারপর কিছু টাকা জমলে, আমরাও ছাদ ঢালাই করব।’

হামিদ সাহেবের বড্ড ভালো লাগল। এ রাইমাকেই তো তিনি চিনেন গত তিরিশ বছর ধরে। রাইমা কি ফের রাইমা হয়ে গেল ? একটু ভাবলেন, তারপর হঠাৎ রাইমার রাগ থর থর দেহটা কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলেন, ঠিক রাইমা যেমন ধরেছিল রিটায়ারমেন্ট নিয়ে ফেরার দিন।

রাইমা বাধা দিল না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম