শরতের শুভ্রতা
‘শরতের আছে শোভা আরো আছে দান,/স্নিগ্ধোজ্জ্বল রবি করে চন্দ্রিকায় ধরা করে ম্লান/নদীনীর হয় স্বচ্ছ, ব্যোমে চলে হাসি কান্না খেলা/শেফালী, কুমুদ, কাশ, কমলেরে কে করিবে হেলা?’ -কবি শেখর কালিদাস শরৎস্তুতি গেয়েছিলেন এভাবে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের মদির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন ‘হে সাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোভাতে।’
শরৎ এসেছে। বকের পালকের মতো সাদা কাশবনে ফুল ফুটে অনুপম হিল্লোল তুলে শরৎ এসেছে। শেফালিকা তালে ছান্দের নাচে ফুলের বর্ণচ্ছটা। সকাল-সন্ধ্যার হাওয়ায় পরিবর্তনও কিছুটা। শরৎ যে এসেছে। শরৎ মাধুর্যের স্নিগ্ধ রূপ কতই না জুড়িয়ে দেয় প্রাণ। প্রকৃতিপ্রেমীরা অবশ্য এমন আশা নিয়েই তাকিয়ে থাকে শরতের দিকে। শরতও একটু একটু করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কখনো মুখ লুকাচ্ছে, কখনো যেন মুখ টিপে হাসছে। স্নিগ্ধ রূপের লাবণ্যে কতই না রহস্য শরতের। শরতের ফুল শেফালীর (শিউলি নামেও ডাকা হয়) সাথে নাম না জানা কত না বনফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে পথে-প্রান্তরে। বর্ষায় ফোটা সেই ফুলগুলো বালুচরের কাশবনের পথ ধরে শরতের ফুলগুলোকে টেনে আনছে। প্রকৃতির এই নিসর্গ দেখতে হলে যেতে হবে নদীতীরে। এই তো ক’দিন আগেও যে তীর ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর সঙ্গে গড়ে তুলেছিল সখ্য সেই তীরই এখন এনে দিচ্ছে যেন কিছুটা বিষণœ।
ভোরের কোমল স্নিগ্ধ আলো শিশিরসিক্ত সূর্য ধরনীতে উদ্ভাসিত হয় ঠিকই, খানিক বাদেই মেঘে ঢেকে যায়। ছিঁটেফোটা বৃষ্টির পরশ বুলিয়ে দিয়ে ফের রোদ ওঠে। ফের ধোঁয়াসা মেঘের আড়ালে শরতের এমন লুকোচুরি খেলায় সাদা মেঘের ভেলা যায় হারিয়ে।
আমন ধান চাষ হয়ে থাকে এ সময়েই। শরতের সময়টাজুড়ে পরিচর্যা করতে হয় আমনের আবাদ। এই আমনের ওপর নির্ভর করে ঘরে খাবার। শরতের হাত ধরে আসে হেমন্ত। হেমন্ত মানেই নবান্ন। শরতের মাধুর্যের রূপ টেনে নিয়ে যায় নবান্নের দিকে। শরতের ওপর ভর করে কৃষক আশায় বুক বেঁধে থাকে নতুন ধানের দিকে। ধানের ক্ষেত রৌদ্রছায়ায় প্রহর গোনে। প্রশান্তির পরশ বুলাতে ফোটে টগর মালতি।
ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশে বাংলা ষড়ঋতুর অন্যতম এবং প্রকৃতিক মনোমুগ্ধকর তৃতীয় ঋতু শরৎ। শরৎ ঋতুর দু’টি মাস। ভাদ্র ও আশ্বিন। বাংলা সব মাসের মতো এ দু’টি মাসের নামও রাখা হয়েছে গ্রহ-উগ্রহ-নক্ষত্রের নাম অনুসারে।
শাপলা-শালুক, পদ্ম, শিউলি, কামিনী, জবা ও কাশফুল শরতের সাথে মিশে আছে ওতোপ্রতভাবে। শিশিরভেজা প্রভাতে শিউলি ফুল এ ধরায় জানান দিয়েছে শরৎ এসেছে। শরৎকে শুভ্রতার প্রতীক বলা হয়। কারণ কাশ-শিউলি আর সাদা মেঘের আনাগোনা-সবকিছুই পবিত্রতার উপাদানে সজ্জিত। তার দুই অনিন্দ্য সুন্দর উপাদান কাশ আর শিউলি। সকালে গাছের তলায় ছড়িয়ে সিঁদুরে লাল বোঁটার শুভ্র শিউলি। দিনের আলোয় সে যেন একেবারেই নিষ্ফলা। একটি ফুলও থাকে না। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই পুষ্পকলিরা আসর সাজিয়ে বসে। গন্ধ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। তারপর অভিমানী ফুলেরা ভোরের আলো ফোটার আগেই ঝরে পড়ে গাছতলায়। ‘শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরাফুলের রাশে রাশে’। সূর্যের সাথে তাদের আজন্ম বৈরিতা। মূলত শরতের দ্বিতীয় ভাগে আশ্বিন মাসেই শিউলি ফুটতে শুরু করে। ‘আশ্বিনের উৎসব সাজে শরৎ সুন্দর শুভ্র করে/শেফালির সাজি নিয়ে দেখা দিবে/তোমার অংগনে।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
শিউলির বোঁটার রঙ একসময় মিষ্টান্নে ব্যবহৃত হতো। এ কারণে রঞ্জক হিসেবেও এ ফুলের খ্যাতি ছিল। শরতের গভীর রাতে আরেক নিসর্গ। সুনসান নীরবতার শব্দ, শিশির ঝরার শব্দ, ভরা চাঁদের পূর্ণিমা রাতে গ্রহ-নক্ষত্রের গুঞ্জনের শব্দ, মনে মনে কিছু ভাবার শব্দও এনে দেয় শরৎ। এই হৃদয়ের শব্দের ভুবনে কখনো সুর হয়ে বাজে সেই গান... এমনই শারদ রাতে তোমায় আমায় দেখা হলো সেই আঙ্গিনায় জ্যোৎøাতে, তখন বাতায়ন আঙ্গিনার পাশে শেফালী রহিছে পড়ে...।
শরতের রূপ রঙ আর সব ঋতুর মতো প্রকট নয়, শরতের রূপের কাছে ওইসব রঙ একেবারে ম্লান। শরৎ আসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যার সাথে অন্য ঋতুগুলোর কোন মিল নেই। শরৎ শান্ত নদী শান্ত ঢেউ গোধূলি লগনের মিষ্টি রোমান্টিকতায় ভরিয়ে দেয়। শারদীয় প্রভাতের পর ঝলমলে রোদেলা আকাশের সুর ভাসে মেঘের ভেলা। শরতের সুরের ব্যঞ্জনায় প্রকৃতি সেজেগুজে ছন্দের তালে নেচে ওঠে।
শরতের আকাশ কখনো ধোয়ামোছা পরিষ্কার থাকে না। আলো ঝলমল নীলাকাশের গায়ে দিনমান ঘুরে বেড়ায় ছেঁড়াখোড়া মেঘ। পালতোলা এসব মেঘ পেঁজাতুলোর মতো তুলতুলে নরম। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে যায় দূরে কোথাও।
শরতের বিকেল যেন অপরূম মোহনীয়। হেলে পড়া সূর্যের আলো নদী ও বিলের পানিতে হীরক আলো ফেলে। সে আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় পুঁটি মাছের রুপালি ঝিলিক। হয়তো এ বিকেলে কোন ডোবায়র পানিতে ছিপ ফেলে গ্রামের দস্যি ছেলের দল।
কৃষকরা মহাব্যস্ত সোনালি আঁশ খ্যাত পাট কাটা, কাঁচা পাট পানিতে ডোবানো, ধোয়া ও শুকাতে। হয়তো এ বিকেলে দেখা যাবে পাট বোঝাই নৌকা যাচ্ছে কোন দূরগঞ্জে। এছাড়া আশ্বিনে নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে মেলা। শারদীয় দিনের অন্যতম অনুষঙ্গ কাশ-শিউলির সঙ্গে শারদীয় উৎসবও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় উৎসবের পালনও এ শরতেই। শরতকে ঘিরে কত কথা, কত গান, কত কবিতা, কত ছন্দ। ঋতুবৈচিত্র্যে প্রকৃতির এমন মধুময়তা আর কি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়!
লেখক: সাংবাদিক।