
প্রিন্ট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৪৬ এএম
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মৃত্যুর সম্মোহন

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
যে কোনো ব্যক্তির আত্মহত্যার ঘটনা প্রশ্ন রেখে যায়, ‘কেন?’ এ প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দাঁড়ায় যখন আত্মহননকারী ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ কেউ হন, এবং মৃত্যুর চেয়ে বরং তার বেঁচে থাকার প্রয়োজন অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হতো। আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের (১৮৯৯-১৯৬১) ক্ষেত্রেও একথা সত্য। তার বন্ধু অ্যারন এডওয়ার্ড হচনার (১৯১৭-২০২০), যিনি নিজেও খ্যাতিমান সম্পাদক ও সাহিত্যিক ছিলেন, হেমিংওয়ের আত্মহত্যা তাকে হতবাক করেছিল। সমালোচকরা যাকে শতাব্দীর সেরা লেখক হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যিনি তার অনন্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার ও পুলিৎজার পুরস্কার, ভাগ্যের সৈনিক হিসাবে যিনি শীতকালে শিকার করার জন্য আইডাহোর এক পার্বত্য শহরে ও ফ্লোরিডার কী ওয়েস্টে বাড়ি কিনেছিলেন, নিউইয়র্ক সিটিতে, প্যারিস, টরন্টো এবং ভেনিসে ছিল তার অ্যাপার্টমেন্ট, মাছ ধরার জন্য কিনেছিলেন একটি ইয়ট, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শেয়ার ও নগদ অর্থ ছিল, মাথায় শটগান ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করার এমন কী প্রয়োজন পড়েছিল?
এ ধরনের প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর সব সময় পাওয়া যায় না এবং এসব ক্ষেত্রে আত্মহত্যাকারীর মানসিক বৈকল্যকে দায়ী করা হয়। জীবনের একটি পর্যায়ে এসে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যে মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক যাতনায় ভুগছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যালেরিয়া, আমাশয়, ত্বকের ক্যানসার, উচ্চরক্তচাপ তাকে অস্থির রাখত। তার মাথাব্যথা, কানে সার্বক্ষণিক এক ধরনের শব্দ শোনা সম্ভবত বিভিন্ন সময়ে তার দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার কারণে মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তিনি ব্যথা নিবারক ওষুধ ছাড়াও মদ্যপানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হেমিংওয়ে জীবনের শেষ বছরগুলোতে যে আচরণ করতেন, একই ধরনের আচরণ তার পিতাও করতেন আত্মহত্যা করার আগে। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকরা এ উপসংহারে উপনীত হয়েছেন যে, হেমিংওয়ের পরিবার বংশগত ‘হেমোক্রোমাটোসিস’ নামে মানবদেহে আয়রনের আধিক্যজনিত ব্যাধির শিকার ছিল। আয়রন রক্তের সঙ্গে মিশে অন্ত্র, হৃৎপিণ্ড, যকৃতসহ অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মানসিক ও শারীরিক অবনতি ঘটে। হেমিংওয়ের এক বোন, এক ভাই এবং এক নাতনি একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। হেমিংওয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, তার স্মৃতিবিভ্রম ঘটেছিল। আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে তিনি নিজেকে পৃথিবীর মায়া থেকে মুক্ত করেছেন ,এসব কারণে তিনি হয়তো মৃত্যু দ্বারা তাড়িত বা সম্মোহিত ছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় সক্রিয়ভাবে এমন অভিজ্ঞতা লাভের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, যা তাকে মৃত্যুর ভাবনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সৈনিক হিসাবে তিনি যেসব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও প্রত্যক্ষ করেছেন, যেমন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসাবে, গ্রিক-তুরস্কের যুদ্ধ, স্পেনিশ সিভিল ওয়ার ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাংবাদিক হিসাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ইটালিতে আহত হয়ে ছয় মাস হাসপাতালে কাটান। প্রতিটি যুদ্ধে তার উপস্থিতির সময় তাকে সসম্মানে মৃত্যুবরণের ওপর আলোচনা ও অধ্যয়ন করতে দেখা গেছে। আমেরিকান গড় আয়ুর হিসাবে তিনি কম বয়সে মারা গেছেন। নিজের জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলার আগে তিনি ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’, ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’, ‘অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’. ‘ডেথ ইন দ্য আফটারনুন’, ‘ম্যান উইদাউট ওম্যান’ এবং অন্যান্য সাড়া জাগানো উপন্যাস রচনা করে বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।
হেমিংওয়ের কাছে মৃত্যু ছিল তার আরাধ্য এক চূড়ান্ত পর্যায়, যা তার চেতনাকে তীব্র ও তীক্ষ্ণ করে তুলেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কীভাবে মৃত্যুর বাস্তবতাকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া সম্ভব হবে, তার সেই ভাবনাকে বিবেচনায় নিলে হেমিংওয়ে একজন গভীর অস্তিত্বের লেখক। তিনি লিখেছেন, ‘যারা মৃত্যুর কাছাকাছি থাকেন, তারা তাদের জীবনের পরিপূর্ণতার মধ্যে বেঁচে থাকেন।’ তার উপন্যাসের নায়করা যেভাবে নিজেদের মৃত্যুর মুখে পরিচালনা করে, তা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, তিনি মৃত্যুকে কতটা কাছের মনে করেছেন এবং তারা কীভাবে মৃত্যুর অনিবার্যতার মুখে মৃত্যুর মর্ম তৈরি করে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করেছেন। এসব এসেছে তাদের চারপাশের বিদ্যমান অবস্থা থেকে, তাদের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে। এর বাইরে অন্য কোনোকিছু থেকে নয়। হেমিংওয়ের নায়ক কোনো বিমূর্ত ধারণা, দর্শন বা বিশ্বাসকে খুব কম ব্যবহার করেছেন।
মৃত্যুর সার্বক্ষণিক ভাবনা অনেক সময় মৃত্যুর চেয়েও জটিল ও কঠিন এক মানসিক পরীক্ষা। হেমিংওয়ে যদিও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াকে তার লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন; এমনকি মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার অবস্থাকে উদযাপন করেছেন, তা সত্ত্বেও তার পিতার আত্মহত্যার মতো অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাকে সহিংস আচরণের মুখে পড়তে হয়েছে। ১৯৪৪ সালে তিনি জার্মানি ও বেলজিয়াম সীমান্তে হার্টজেন জঙ্গলে জার্মানদের বিরুদ্ধে আমেরিকান বাহিনীর নৃশংস যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। আফ্রিকায় তার দ্বিতীয় অভিযানের শেষদিকে তিনি পর পর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হয়েও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিটি ঘটনা তার ওপর মৃত্যুর গভীর ছায়া ফেলেছিল। যার অবসান ঘটে ১৯৬১ সালের জুলাইয়ে রাইফেলের গুলিতে তার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। আত্মহত্যা করার সময় তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। হেমিংওয়ের বক্তব্য ‘সকল মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি একই রকম। পৃথিবীতে কীভাবে সে জীবন কাটিয়েছে এবং কীভাবে মারা গেছে, কেবল তা তাকে অন্যদের থেকে পৃথক রাখে,’ তার জীবনের অন্তিম দিনের সঙ্গে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
হেমিংওয়ে যুদ্ধকে ঘৃণা করতেন, তার বিভিন্ন উপন্যাস ও লেখায় তুলে ধরেছেন। তার ‘নেক্সট ওয়ার্ল্ড অন দ্য নেক্সট ওয়ার’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘পুরোনো দিনগুলোতে তারা লিখে গেছেন যে, কেউ যদি তার দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করে তাহলে সেই মৃত্যু মধুর এবং যথার্থ। কিন্তু আধুনিককালের যুদ্ধে মৃত্যুতে মধুরতা বা যথার্থতা বলে কিছু নেই। কোনো কারণ ছাড়াই তুমি কুকুরের মতো মরবে।’