Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অমূল্য স্মৃতির আকর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

রাজীব সরকার

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অমূল্য স্মৃতির আকর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড উপাধিতে একদা ভূষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ অতিক্রম করেছে ২০২১ সালে। এ উপলক্ষ্যে ‘সেঞ্চুরিয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বইটি প্রণয়ন করেছেন বিশিষ্ট কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আন্দালিব রাশদী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ইতঃপূর্বে বহু গবেষণাধর্মী বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটি গতানুগতিক কোনো গবেষণাগ্রন্থ নয়। বিভিন্ন মনীষীর স্মৃতিকথা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অংশটুকু দক্ষ ডুবুরির মতো সেচে স্মৃতির মণিমানিক্য উপহার দিয়েছেন লেখক।

বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মনীষীদের একটি বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করেছেন। কেউ ছাত্র হিসাবে, কেউ ছাত্র ও শিক্ষক হিসাবে, কেউ শিক্ষক হিসাবে কেউবা প্রশাসনিক পদে। কয়েকজন অবাঙালি মনীষীর জীবনও জড়িয়ে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। তাদের আত্মজীবনীর উজ্জ্বল অংশজুড়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যায়। এসব স্মৃতিকথায় তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অসামান্য পরিচয় প্রতিফলিত হয়েছে। যেসব মনীষীর স্মৃতিকথা থেকে এ বই প্রণীত হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই উজ্জ্বল নক্ষত্র। রমেশ চন্দ্র মজুমদার, সত্যেন বসু, বুদ্ধদেব বসু, স্যার এএফ রহমান, প্রফুল্লকুমার গুহ, কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অশোক মিত্র, ভবতোষ দত্ত, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী-যেন প্রতিভার মিছিল। তাদের আত্মকথায় উঠে এসেছে সমকালীন আরও কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের স্মৃতি।

রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রীয় পুরুষ বুদ্ধদেব বসু। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় যে নম্বর তিনি পেয়েছিলেন, তা এখনো পরবর্তী কৃতীদের স্পর্শের বাইরে। ‘আমার যৌবন’ বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হলাম, তখন থেকে আমার মধ্যে নতুন জীবন এলো।’ আন্দালিব রাশদী বুদ্ধদেব বসুর অপূর্ব গদ্যের চুম্বকাংশ উপস্থাপন করেছেন-‘ভিতরের জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনের-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস, আছে ব্যায়ামাগার ও জলক্রীড়ার জন্য পুষ্পরিণী-যেখানে-সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংল্যান্ড দেশীয় পল্লিনিবাসের মতো ঢালু ছাদের এক একটি দোতলা বাড়ি-নয়ন-হরণ, বাগানসম্পন্ন, সেখানে কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকরা; অন্যদের জন্যও নীলক্ষেতে ব্যবস্থা অতিসুন্দর। স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি।’

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যায় ক্ষুব্ধ হয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৯২৮’ কবিতাটি। এ অসামান্য কবিতাটি এ বইয়ে সংকলিত হয়েছে।

উপমহাদেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক অশোক মিত্রের বিখ্যাত স্মৃতিগ্রন্থ ‘আপিলা চাপিলা’। এ বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। তার ভাষায়, ‘প্রায় হলফ করেই বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পঁচিশ বছর প্রায় যে কোনো বিভাগে শিক্ষকমণ্ডলীর জ্ঞান, মেধা ও প্রতিভার জুড়ি সারা দেশে পাওয়া সত্যিই মুশকিল হতো।’ সুদর্শন ও সুপণ্ডিত সুনীল কুমার দে ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অশোক মিত্রের ভাষায় ‘ছাত্রীদের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না।’ অর্থনীতির অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্তের চেয়ে দক্ষতার শিক্ষক তিনি দেশে-বিদেশে কোথাও পাননি।

কবীর চৌধুরীর স্মৃতিকথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের খ্যাতিমান অধ্যাপক আন্দালিব সাদানির কথা স্মরণ করেছেন লেখক। উর্দু ভাষার প্রতি তার জন্মগত দুর্বলতা ও পক্ষপাত থাকা সত্ত্বেও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজনে তিনি ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতির নেপথ্যে গুণী শিক্ষকদের ভূমিকা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন সরদার ফজলুল করিম। তার ভাষায়, ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবী বিখ্যাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি প্রশংসাবাক্য প্রচারিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। অক্সফোর্ডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী আমার জানা নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে যে তখনকার ভারত উপমহাদেশের জ্ঞানী-গুণীদের মধ্যে বেশকিছু শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আর ছাত্র হিসাবে সেটিই ছিল আমাদের গর্ব এবং গৌরবের বিষয়। তা না হলে কলকাতা বা লখনৌ বা কাশী বা আগ্রা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অজপাড়াগাঁয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাঁড়াবার উপায় ছিল না।’

আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘কাল নিরবধি’তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। হল সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন-‘নির্বাচনের পর ৯২(ক) ধারায় হল সংসদের সভাপতি গ্রেফতার হলেন, আলাউদ্দিন আল আজাদকে আত্মগোপন করে থাকত হলো। দেখতে দেখতে ১৯৫৪-৫৫ সালে নির্বাচন এসে গেল। দুই বছরের বরাদ্দ দিয়ে একটা বার্ষিকী করতে গিয়েও দেখা গেল বাজেটে কুলাচ্ছে না। তারা একটি অসাধ্য কাজ করলেন, বিনাপয়সায় জয়নুল আবেদিনকে দিয়ে প্রচ্ছদ করালেন। কাদায় আটকে পড়া চাকা টেনে তোলার ছবি-সেটাই সম্ভবত প্রথম ভার্সন। সূচিপত্র একটি চমৎকার আবহ তুলে ধরে। এতে রম্যরচনা লিখেছেন-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, আলাউদ্দিন আল আজাদ: প্রবন্ধ মুহম্মদ আবদুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন ও আনিসুজ্জামান : শামসুর রাহমানের প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কবিতাটি এই বার্ষিকীতেই ছাপা হয়।’

‘কালোর ধুলোয় লেখা’ শামসুর রাহমানের অসাধারণ স্মৃতিকথা। কাব্যচর্চা, পড়াশোনা, প্রেম সবকিছুর অকপট বিবরণ দিয়েছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় কবি হয়ে ওঠার পূর্বাভাস তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘পরীক্ষায় কৃতিত্বের ঝলক দেখাতে না পারলেও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আমার কিছু সাফল্য ধরা পড়েছিল সে সময়ে কারও কারও কাছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমার লেখায় একজন ভালো কবির আভাস পেয়েছিলেন-এ কথা আমি বুঝতে পারি তার উদার আচরণে।’

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তার স্মৃতিচারণায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন। মুনীর চৌধুরী ও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কণ্ঠে দু’ধরনের জাদু ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রিয় শিক্ষক হারানোর স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘অমুসলমানদের দেশত্যাগের হিড়িক দেখে জ্যোতির্ময় গুহ বলেছিলেন, আমরা ঢাকার মানুষ, দাঙ্গার ভয় পাই না। ভয় না পাওয়ার চরম মূল্য দিয়েছিলেন একাত্তরে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সি ছাত্রাবাস এসএম হল ও জগন্নাথ হল। পৃথক অধ্যায়ে এ দুই হলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কীর্তিমান শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্পর্কে প্রাঞ্জল বিবরণ দিয়েছেন লেখক। শুধু পড়াশোনা নয়, সংস্কৃতি চর্চার জন্যও সেকালে জগন্নাথ হলের বিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাইস চ্যান্সেলর রমেশ চন্দ্র মজুমদার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘... ঢাকা শহরে জগন্নাথ হলের নাটকের এমনই সুনাম হয়েছিল, অভিনয়ের সময় টিকিট প্রার্থীদের মধ্যে অনেককেই বিমুখ করতে হতো।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হার্টগ ও প্রথম ছাত্রী লীলাবতী নাগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অধ্যায় বইটির গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রশ্নোত্তর ও বাজেট বিতর্ক অনুসন্ধিৎসু পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে। আন্দালিব রাশদীর নিষ্ঠা ও মুনশিয়ানা প্রশংসার দাবিদার। বইটির অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জানার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকথার অন্তঃসার অনায়াসে পাঠক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। তথ্যে, যুক্তিতে, কৌতুকপ্রিয়তায় ও বিশ্লেষণে সুখপাঠ্য হয়ে ওঠেছে বইটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে মনীষীদের অমূল্য স্মৃতির আকর এ বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।

সেঞ্চুরিয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাস ও স্মৃতি : আন্দালিব রাশদী। প্রকাশক : একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি। প্রচ্ছদ : আবু হাসান। মূল্য : ৬০০ টাকা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম