হান কাং-এর নোবেল বক্তৃতা

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুক্তির বিপরীতে কেন প্রশ্নহীন আনুগত্য অথবা ভাবনার পথে আলো থাকবে, নাকি শুধুই আঁধার-অশান্ত পৃথিবীর এমন মৌলিক জিজ্ঞাসাই যেন হান কাং-এর সাহিত্যভাবনার নিউক্লিয়াস। ইতিহাসের এই ক্রান্তিকালে মানবতার পথ কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? প্রথম এশীয় নারী এবং প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান লেখিকা হিসাবে এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করা হান কাং তার পাঠককে যেন সেই দরজার কাছেই নিয়ে যেতে চান।
গত ৭ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে হান কাং নোবেল বক্তৃতায় মানবতার সহিংসতার ক্ষমতা এবং এর অভ্যন্তরীণ মর্যাদার মধ্যে নাজুক সংযোগের ওপর আলোকপাত করেছেন। তিনি তার কাজের মধ্যে স্মৃতি এবং ঐতিহাসিক প্রতিফলনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন। নোবেল প্রাইজের অফিসিয়াল সাইটে প্রকাশিত সেই বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরেছেন মেজবাহ উদ্দিন
গত জানুয়ারিতে, আমার স্টোররুম গোছানোর সময় আমি একটি পুরানো জুতোর বক্স পেয়েছিলাম। বক্সটি খুলে দেখলাম অনেক পুরোনো ডায়েরি, যা আমার শৈশবের সময়কার। ডায়েরিগুলোর স্তূপের মধ্যে একটি পাম্পলেট ছিল, যার ওপরে পেনসিলে লেখা ছিল ‘A Book of Poems’। বইটি ছিল পাতলা : পাঁচটি সাধারন এ-ফাইভ সাইজের পৃষ্ঠা, যেগুলো অর্ধেক ভাঁজ করা এবং স্ট্যাপল করে আটকানো। পেছনে ১৯৭৯ সাল এবং আমার নাম লেখা, এবং ভতরে একই পেনসিলে লেখা মোট আটটি কবিতা ছিল। প্রতিটি পাতার নিচে ক্রমানুসারে ভিন্ন ভিন্ন তারিখ লেখা ছিল। আট বছর বয়সি আমার হাতে লেখা লাইনগুলো নিষ্পাপ এবং অপরিশীলিত ছিল। সেখানে এপ্রিল মাসের একটি কবিতা এইভাবে শুরু হয়েছিল :
‘কোথায় ভালোবাসা? এটি আমার কম্পমান বুকের ভেতর। ভালোবাসা কী? এটি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে সংযোগকারী সোনালি সুতো।’
কবিতার বইটি থেকে এক মুহূর্তে আমি চল্লিশ বছর পেছনে ফিরে গেলাম এবং সেই অপরাহ্নের স্মৃতিগুলো ফিরে এলো। আমি স্টোররুমে ছড়িয়ে থাকা পাম্পলেটগুলো একত্রিত করতে বসে গেলাম। আমার ছোট মোটা পেনসিল, ধুলোমাখা রাবার, সেই বড় ধাতুর স্ট্যাপলারটি, যা আমি বাবার ঘর থেকে চুরি করে এনেছিলাম। ডায়েরি এবং বইটি যেমন ছিল তেমনভাবেই আবার রেখে দেওয়ার আগে আমি সেই কবিতাটির একটি ছবি তুলে নিয়েছিলাম আমার ফোনে। আমি এটি করেছিলাম এক ধরনের অনুভূতির কারণে যে, তখন আমি যেসব শব্দ লিখেছিলাম, তার সঙ্গে এখনকার আমি কিছুটা সম্পর্ক অনুভব করি। আমার বুকের ভেতরে, আমার সক্রিয় হৃদয়ে সোনালি সুতো যুক্ত করে- একটি সুতো যা আলো নির্গত করে।
... আমি কবিতা ও ছোট গল্প লেখার প্রক্রিয়ায় আগ্রহী ছিলাম, তবে উপন্যাস লেখা আমার কাছে একটি বিশেষ আকর্ষণ। আমার বইগুলো সম্পূর্ণ হতে এক বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছে, যার জন্য আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ বিনিময় করেছি। এটি আমাকে কাজের দিকে আকর্ষণ করে। প্রতিটি উপন্যাস লেখার সময়, আমি কিছু প্রশ্নের মধ্য দিয়ে যাই, আমি সেগুলোর মধ্যে বাস করি। যখন আমি এ প্রশ্নগুলোর শেষ প্রান্তে পৌঁছাই-যখন আর সেগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার মতো নয়-তখন আমি লেখার প্রক্রিয়া শেষ করি। তখন আমি আগের মতো থাকি না, এবং সেই পরিবর্তিত অবস্থান থেকে, আমি আবার শুরু করি। পরবর্তী প্রশ্নগুলো আসতে থাকে, একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং একটানা চলতে থাকে এবং আমি নতুন কিছু লেখার জন্য প্ররোচিত হই।
২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমার তৃতীয় উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান লেখার সময়, আমি কিছু কষ্টকর প্রশ্নের মধ্যে বাস করছিলাম : একজন ব্যক্তি কি সম্পূর্ণ নির্দোষ হতে পারে? আমরা সহিংসতাকে কতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করতে পারি? এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে কী ঘটে যে মানব জাতির অংশ হতে অস্বীকার করে?
সহিংসতা প্রত্যাখ্যানের জন্য মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত শুধু পানি ছাড়া আর কিছু না খেয়ে বিশ্বাস করে যে সে একটি উদ্ভিদে রূপান্তরিত হয়েছে, ইওয়ং-হেই, ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ এর প্রধান চরিত্র, এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পড়ে; যেখানে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মৃত্যুর দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আমি শেষ দৃশ্যটি একটি অ্যাম্বুলেন্সে সেট করেছি, কারণ আমি আশা করেছিলাম যে ইওয়ং-হেই এই কাহিনির দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে। অ্যাম্বুলেন্সটি পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে, যেখানে উজ্জ্বল সবুজ পাতা ছড়িয়ে রয়েছে, আর সতর্ক বড় বোন জানালার দিকে নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে। হয়তো প্রতিক্রিয়া আশা করছে, বা হয়তো প্রতিবাদ করছে। পুরো উপন্যাসটি একটি প্রশ্নের মধ্যে অবস্থান করছে। তাকানো এবং অস্বীকার করা। প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা।
দ্য ভেজিটেরিয়ান-এর পরবর্তী উপন্যাস ইঙ্ক অ্যান্ড ব্লাড, এ প্রশ্নগুলোকে চালিয়ে নিয়ে যায়। জীবন এবং পৃথিবীকে প্রত্যাখ্যান করা এবং সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করার জন্য এটা একটি অসম্ভবতা। আমাদের শেষ পর্যন্ত তো উদ্ভিদে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে আমরা কীভাবে এগিয়ে চলতে পারি?
...তখন পর্যন্ত, আমি গোয়াংজু নিয়ে লেখার কথা ভাবিনি। যখন আমার পরিবার জানুয়ারি ১৯৮০-এ গোয়াংজু ছেড়ে চলে যায় আমি তখন নয় বছর বয়সি ছিলাম, প্রায় চার মাস আগে যে সময় গণহত্যাগুলো শুরু হয়েছিল। কয়েক বছর পর, যখন আমি ‘গোয়াংজু ফটো বুক’-এর উলটানো পৃষ্ঠদেশটি একটি শেলফে দেখেছিলাম আমি তখন বারো বছর বয়সি। এ বইটি গোয়াংজুর বাসিন্দা এবং ছাত্রদের ছবি ধারণ করেছিল-যাদের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং বন্দুকের গুলিতে মারা হয়েছিল, যখন তারা নতুন সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছিল। যারা এ বইটি প্রকাশ ও বিতরণ করেছিল তারা ছিল গণহত্যার সময় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি এবং মৃতদের পরিবারের সদস্য, যারা সে সময় কঠোর মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সত্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এটি করেছিলেন।
শিশু অবস্থায়, আমি ওই ছবিগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পারিনি, কিন্তু ধ্বংসপ্রাপ্ত মুখগুলো আমার মনে মানুষের প্রতি একটি মৌলিক প্রশ্ন হিসাবে থেকে গিয়েছিল: এটা কি একজন মানুষের প্রতি অন্য একজন মানুষের আচরণ? এবং তারপর, অন্য একটি ছবি দেখে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতালের বাইরে রক্তদান করার জন্য মানুষের একটি অন্তহীন সারি দাঁড়িয়ে ছিল : এটাও কি একজন মানুষের প্রতি অন্য একজন মানুষের আচরণ? এ দুটি প্রশ্ন একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল এবং তাদের ভিন্নতা আমার কাছে একটি কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা আমি ছাড়াতে পারিনি।
২০১২ সালের এক বসন্তের দিনে, যখন আমি একটি উজ্জ্বল, জীবন-সম্পর্কিত উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছিলাম, আমি আবারও সে অমীমাংসিত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমি অনেক আগেই মানুষের প্রতি গভীর আস্থা হারিয়েছিলাম। তাহলে, আমি কীভাবে পৃথিবীকে গ্রহণ করব? আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যদি আমি এগিয়ে যেতে চাই, তবে আমাকে অবশ্যই এ অসম্ভব ধাঁধার মুখোমুখি হতে হবে। আমি বুঝলাম যে লেখাই ছিল আমার একমাত্র উপায় এ ধাঁধা কাটিয়ে ওঠার।
এরপর আমি বছরের বেশির ভাগ সময় নিয়ে উপন্যাসের রূপরেখা তৈরি করছিলাম, কল্পনা করছিলাম যে ১৯৮০ সালের মে মাসের গোয়াংজু নিয়ে বইটিতে একটি স্তর থাকবে। আমি নিজেকে বলেছিলাম, আমার পরবর্তী উপন্যাসটি গোয়াংজুর দিকে সোজাসুজি তাকাবে। আমি ৯০০টিরও বেশি সাক্ষাৎকারে রচিত একটি বই সংগ্রহ করেছিলাম এবং প্রতিদিন নয় ঘণ্টা করে এক মাস ধরে প্রতিটি সাক্ষ্য পড়েছিলাম। তারপর আমি শুধু গোয়াংজু নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে পড়েছিলাম। তারপর, আরও দূরে এবং অতীতের দিকে তাকিয়ে আমি বিশ্বের ইতিহাসে মানবজাতির মধ্যে বারবার সংঘটিত গণহত্যাগুলো সম্পর্কে পড়েছিলাম।
এ উপন্যাসটির কাজ করার সময়, দুটি প্রশ্ন সব সময়ই আমার মনের মধ্যে ছিল। বর্তমান কি অতীতকে সাহায্য করতে পারে? বেঁচে থাকারা কি মৃতদের উদ্ধার করতে পারে? যখন আমি আমার গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলাম, তখন এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, এ প্রশ্নগুলো খুবই অসম্ভব। মানবতার সবচেয়ে বিষাদপূর্ণ দিকগুলোর সঙ্গে এ টানা সাক্ষাতের মাধ্যমে, আমি আমার দীর্ঘকালের ভাঙা বিশ্বাসের অবশেষগুলো পুরোপুরি বিধ্বস্ত হতে দেখলাম। আমি প্রায় বইটি ছেড়েই দিয়েছিলাম। তারপর আমি এক রাতে স্কুল শিক্ষক পার্ক ইয়ং-জুনের ডায়েরি পড়ি। এক লাজুক, চুপচাপ যুবক, পার্ক ইয়ং-জুন ১৯৮০ সালের মে মাসে গোয়ংজুতে দশদিনের গণ-অভ্যুত্থানে স্বাধীনচেতা নাগরিকদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল YWCA ভবনে, যেখানে তিনি রাতে থেকে গিয়েছিলেন এটা জানা সত্ত্বেও যে সৈন্যরা সকালের আগেই ফিরে আসবে। সেই শেষ রাতে, তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘কেন, ঈশ্বর, আমাকে এমন মানসিকতা দিতে হবে যা আমাকে কষ্ট এবং ব্যথা দেয়? আমি বাঁচতে চাই।’ এ বাক্যগুলো পড়ে, আমি প্রচণ্ড নাড়া খেলাম, এবং বিদ্যুতের আলোর মতো আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, কীভাবে উপন্যাসটি এগিয়ে যাবে। এবং বুঝতে পারলাম আমার মনে যে দুটি প্রশ্ন ছিল, তা আসলে উলটোভাবে হবে। অতীত কি বর্তমানকে সাহায্য করতে পারে? মৃতরা কি জীবিতদের রক্ষা করতে পারে?
পরে, যখন আমি ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ নামক উপন্যাসটি লিখছিলাম, আমি অনুভব করেছিলাম যে, কিছু মুহূর্তে, অতীত সত্যিই বর্তমানকে সাহায্য করছিল এবং মৃতরা জীবিতদের রক্ষা করছিল। অনেক দিন আগে সে ছবির বইটি দেখার পর যে প্রশ্নগুলো আমার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল তা হলো : মানুষ এতটা হিংস্র কীভাবে হতে পারে? আবার কীভাবে তারা একই সময়ে এমন বিপুল হিংসার বিপরীতে দাঁড়াতে পারে? মানব জাতির সদস্য হওয়ার মানে কী? এ দুটি অতিরিক্ত মানবিক অন্ধকার এবং মানব মর্যাদার মধ্যে শূন্য স্থানটি পার করতে, আমার মৃতদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। ঠিক যেমন এ উপন্যাস, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’-এ, শিশু দং-হো তার মায়ের হাত টেনে তাকে সূর্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়।
বইটি যখন ২০১৪ সালের বসন্তে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, আমি অবাক হয়েছিলাম যে পাঠকরা বইটি পড়ে কষ্টের কথা স্বীকার করেছিলেন। আমাকে কিছু সময় নিতে হয়েছিল চিন্তা করার জন্য, যে কষ্ট আমি লেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে অনুভব করেছিলাম এবং আমার পাঠকরা যে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন তা কীভাবে সংযুক্ত হলো। সে কষ্টের পেছনে কী থাকতে পারে? এটা কি এমন যে আমরা মানবজাতির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখতে চাই এবং যখন সেই বিশ্বাস দুলে যায়, তখন আমাদের মনে হয় যে আমাদের নিজস্ব অস্তিত্ব ভেঙে পড়ছে? এটা কি এমন যে, আমরা মানবজাতিকে ভালোবাসতে চাই, এবং এই হচ্ছে সেই কষ্ট যা আমরা অনুভব করি যখন সেই ভালোবাসা ভেঙে যায়? ভালোবাসা কি কষ্ট সৃষ্টি করে এবং কিছু কষ্ট কি সেই ভালোবাসার প্রমাণ?
‘হিউম্যান অ্যাক্টস’-এর কোরিয়ান সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর আমার মনে আগের দুই প্রশ্ন থেকেই নতুন প্রশ্ন তৈরি হতে শুরু করেছিল : বিশ্ব এত সহিংস এবং বেদনায় ভরা কেন? এবং তবুও, এই পৃথিবী এত সুন্দর কীভাবে হতে পারে? দীর্ঘ সময় ধরে আমি বিশ্বাস করতাম যে, এ দুই বাক্যের মধ্যে যে উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ছিল, তা ছিল আমার লেখার মূল চালিকাশক্তি। আমার প্রথম উপন্যাস থেকে শুরু করে আমার সর্বশেষ উপন্যাস পর্যন্ত, আমার মনের মধ্যে যেসব প্রশ্ন ছিল তা ক্রমাগত পরিবর্তিত এবং বিকশিত হচ্ছিল, তবে এ দুটি প্রশ্ন স্থির ছিল। কিন্তু দু-তিন বছর আগে আমি সন্দিহান হতে শুরু করলাম। আমি কি সত্যিই ২০১৪ সালের বসন্তে ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’-এর কোরিয়ান প্রকাশনার পরই ভালোবাসার সেই ব্যথা যা আমাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে-সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা শুরু করেছিলাম? আমার প্রথম উপন্যাস থেকে শুরু করে আমার সর্বশেষ উপন্যাস পর্যন্ত, আসলে কি ভালোবাসাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে পুরোনো এবং মৌলিক সুররেখা?
যখন আমি লিখি, আমি আমার শরীর ব্যবহার করি। আমি দেখার, শোনার, ঘ্রাণ নেওয়ার, স্বাদ নেওয়ার, কোমলতা এবং উষ্ণতা, ঠান্ডা এবং ব্যথা অনুভব করার, আমার শরীরের খাদ্য ও জলের প্রয়োজন বুঝতে পারা, হাঁটা ও দৌড়ানোর, বাতাস, বৃষ্টি এবং তুষার আমার ত্বকে অনুভব করার, হাত ধরার সব ইন্দ্রিয়গত বিবরণ ব্যবহার করি। আমি এ জীবন্ত অনুভূতিগুলো, যা আমি একজন রক্তপ্রবাহিত নশ্বর জীব হিসাবে অনুভব করি, আমার বাক্যে সঞ্চার করার চেষ্টা করি। যেন আমি একটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ পাঠাচ্ছি।
আর যখন আমি অনুভব করি যে এ প্রবাহ পাঠকের কাছে পৌঁছেছে, তখন আমি বিস্মিত এবং আবেগপ্রবণ হই। এ মুহূর্তগুলোতে আমি ভাষার সেই সুতোর সংযোগ আবার অনুভব করি, কীভাবে আমার প্রশ্নগুলো পাঠকদের সঙ্গে সেই বৈদ্যুতিক, জীবন্ত কিছুর মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে। যারা সেই সুতোর মাধ্যমে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং যারা ভবিষ্যতে যুক্ত হবেন, তাদের প্রতি আমি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই।
কোরিয়ান ভাষায় দেওয়া হানের ভাষণটি ই. ইয়াওয়ন এবং পেইজ আনিয়াহ মোরিস নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটের জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
www.nobelprize.org/prizes/literature/2024/han/lecture/