রবীন্দ্র চিন্তায় দারিদ্র্য এবং একজন আতিউর রহমান
অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ড. আতিউর রহমান। দেশবরেণ্য গরিবের অর্থনীতিবিদ, সৃজনশীল লেখক, সবুজ অর্থনীতিবিদ হিসাবে তার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানবিষয়ক গবেষণায় এক ভিন্ন মাত্রিক ধারা সৃজন করেছেন এবং তা অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে অবস্থানকারী নিরন্ন মানুষের কল্যাণে নিরলস কাজ করে চলেছেন। তিনি উন্নয়নের বহুমাত্রিকতা বিবেচনায় অর্থনীতির মূল ধারণাটির সঙ্গে ধারাবাহিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির সংযোগ ঘটিয়ে এর ফলপ্রসূতা তুলে আনার চেষ্টাই শুধু নয়, বাস্তবায়নও করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পূর্বসূরি হিসাবে, বঙ্গবন্ধুর আজীবন লড়াই-সংগ্রামকে নিত্য অনুপ্রেরণার অংশ হিসাবে ধারণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, সংগীত, সাহিত্য, নাটকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও এ একই রবীন্দ্রনাথ যে বাংলার নিরন্ন মানুষের ভাগ্য বদলের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলেন একথা জনসমাজে অল্পবিস্তরই প্রকাশিত হয়েছে। ড. আতিউর রহমান রবীন্দ্রনাথের এ অনাবিষ্কৃত দিকটিকে সযত্নে তুলে ধরেছেন।
‘রবীন্দ্র চিন্তায় দারিদ্র্য ও প্রগতি’ গ্রন্থটিতে নয়টি প্রবন্ধ সংযোজিত করেছেন। প্রতিটি প্রবন্ধের শিরোনামই বলে দেয় এর পূর্বাপর প্রাসঙ্গিকতা। যেমন-‘রবীন্দ্র ভাবনায় দারিদ্র্য নিরসন,’ রবীন্দ্রনাথের লোকহিত চিন্তা ও সমকালীন সমাজবাস্তবতা তেমনি অন্যান্যের মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথের পতিসর’ প্রবন্ধটি অন্যতম। আলোচ্য প্রবন্ধটিতে ড. আতিউর রহমান আমাদের জানাচ্ছেন, ‘পতিসর আমাদের আবহমান বাংলার অন্য গ্রামগুলোর মতোই একটি রূপময় গ্রাম। যে গ্রামে বসবাস সাধারণ মানুষের। যে গ্রামে সকাল হলে পাখি কিচিরমিচির ডাকে। সন্ধ্যায় বাঁশঝাড়ে জোনাক পোকারা উড়ে বেড়ায়। যে গ্রামে ধান, পেঁয়াজ, মরিচ, সরষে উৎপাদিত হয়। যে গ্রামে রাস্তার দু’পাশে ফোটে অজানা-অচেনা হরেক রকম ফুল। যে গ্রামের শিশুরা নাগর নদীতে গোসল করতে ছুটে চলে।’ চিরায়ত গ্রামবাংলার চিরচেনা এরূপ বর্ণনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ যে এ গ্রামের প্রাণ- প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করে গরিব কৃষক প্রজাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন, তারই সাক্ষাৎ মেলে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলির ১১১ সংখ্যক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন-কোথায় প্যারিসের আর্টিস্ট সম্প্রদায়ের উদ্দাম- উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাষি প্রজাদের দুঃখ দৈন্য নিবেদন! এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে। বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক। রবীন্দ্রনাথের অন্তর ছুঁয়ে বাস্তবতা উপলব্ধির জায়গাটিতে আসন নিতে পেরেছিল পতিসরের দারিদ্র্যপীড়িত প্রান্তিক মানুষ। যেখানে কৃষিকাজ, মাছধরা আর প্রকৃতির দানই ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার প্রধান উপায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনবোধ সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে আলোকিত জীবনদানের লক্ষ্যে পতিসরের উন্নয়ন ভাবনা তাকে বিচলিত করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেন, এতদ অঞ্চলের প্রজা-চাষিদের দুর্দশার মূল কারণ অশিক্ষা।
ড. আতিউর রহমানের রবীন্দ্র চিন্তায় দারিদ্র্য ও প্রগতি গ্রন্থে তিনি লিখলেন- ‘সেই উপলব্ধি থেকে প্রায় ২০০টি গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা এবং ৩টি উচ্চবিদ্যালয় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন।’ স্বাস্থ্যসেবাকে সহজীকরণের লক্ষ্যে পতিসরে দাতব্য চিকিৎসালয়, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা, কৃষি সমবায় ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারমূলক কাজেও তিনি হাত দিয়েছিলেন।
নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে ব্যাংকিং সেবাকে সহজ করাই শুধু নয়, তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন, কান পেতে শুনেছেন পতিসরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কান্না, হৃদয়ের অন্তিম আকুতি। ড. আতিউর রহমানের ভাষ্যে তাই উঠে আসে-তিনি গ্রামবাংলার জীবনাচার, লোকাচার, অর্থনীতি সম্পর্কেও ভালো জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আর এ কারণেই পরবর্তীকালে প্রজা সাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, ব্যাংকে মূলধন বৃদ্ধি এসব কর্মকাণ্ড ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ ভাবনার পূর্বাপর লক্ষ্য। তিনি পুত্র ও জামাতাকে কৃষিতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তাদের লিখেছেন ‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্ন গ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ। ফিরে এসে এ হতভাগ্যদের অন্ন গ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে সান্ত্বনা পাবো’ (পৃ: ১১৮- ১১৯)।
রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তি এবং ঐক্যের শক্তির ওপর ছিলেন প্রবল আস্থাশীল। যে কোনো সংকট মোকাবিলায় আত্মশক্তির পরিস্ফুটন ঘটানো জরুরি বলেও তিনি মনে করতেন। বাহ্যিক দারিদ্র্যের চেয়ে মনের দারিদ্র্যকে তিনি অনেক বেশি কঠিন মনে করেছেন। দারিদ্র্যের ভয়কে ভূতের ভয়ের সঙ্গে তুলনা করে সমন্বিত ঐক্যের শক্তির বলে সেই সংকটকে জয় করার পক্ষেও মতামত ব্যক্ত করেছেন। পূর্ববাংলায় কৃষির অমিত সম্ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ হৃদয় দিয়ে, জীবনাচারের শুদ্ধতা দিয়ে পলে পলে উপলব্ধি করেছিলেন বিধায় ওইসব দরিদ্র নিরন্ন প্রজাদের ভাগ্যোন্নয়নে সহজাত একটা দায়বোধ অনুভব করেছিলেন তিনি। আলোচিত গ্রন্থে লেখক যত্নের সঙ্গে সেই বিষয়টি তুলে এনেছেন।
বরেণ্য লেখক ড. আতিউর রহমান তার রবীন্দ্র চিন্তায় দারিদ্র্য ও প্রগতি গ্রন্থে উল্লেখিত প্রবন্ধগুলোর বিশ্লেষণে কবির দারিদ্র্য, দারিদ্র্যের মূলকারণ, দারিদ্র্যনিরসনে করণীয় এবং তার বাস্তব প্রয়োগের প্রতি গভীর অভিনিবেশ নিবিড় যত্নে তুলে এনেছেন, যা সমসাময়িককালেও অতি প্রাসঙ্গিক। এ বিষয়ে পূর্বেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর ভাবনাকেও লেখক পাশাপাশি রেখে বাঙালির দুই আদর্শিক দিকপালের জীবনদর্শন, চিন্তা-চেতনাকে সম্পৃক্ত করে বাঙালির আত্মস্ফুরণ-আত্মোন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টায় লেখক সফল হয়েছেন বলেই আমি বিশ্বাস করি।