Logo
Logo
×

অন্যান্য

গুরুত্ব-গুরুত্বহীনতা প্রয়োজন ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল

Icon

শারমিন সুলতানা তন্বী

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৪ পিএম

গুরুত্ব-গুরুত্বহীনতা প্রয়োজন ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল

আজকের সময়, প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে যা সঠিক বলে কিংবা একান্ত সত্য বলে মনে হয় তা আগামীতে বেঠিক কিংবা মিথ্যা বলে মনে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে এটি যে শুধু সময় ও পরিস্থিতিসাপেক্ষ তা নয়। আপেক্ষিকতার সূত্রেও বস্তু, বিষয় বা সঠিক-বেঠিককে বিচার করা যায়। একের কাছে যা সর্বসাকুল্যে গ্রহণযোগ্য তা অন্যের কাছে অগ্রহণযোগ্য হতেই পারে। 

বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা মূলত সময় সাপেক্ষ প্রত্যয়। ব্যক্তি কখনো কোনো সংস্কার বা নিয়মকে ধ্রুব বলে মননে ধারণ করতে পারে না। কেননা সময় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি সত্যকে, নিয়মকে আবার কখনো কখনো আদর্শকেও নাড়া দিয়ে ভিন্ন চিত্রে উপস্থাপন করতে পারে। সেজন্য বিষয়, বস্তু, সত্য, বচন-প্রবচন, নিয়ম, প্রথার গ্রহণযোগ্যতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে ব্যক্তির প্রয়োজন ও পরিস্থিতির উপর।

আপাতদৃষ্টিতে মনে বস্তু বা বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞান বা সত্য পরিমাপের নির্দিষ্ট মানদণ্ড নিশ্চয়ই আছে বা থাকা প্রয়োজন। তবে থাকা প্রয়োজন কিনা- সেটি এক বিষয় আর আছে কি না সেটি আরেক বিষয়। 

ব্যক্তি মূলত তার বোধ, আদর্শ এবং প্রয়োজনের দাস। এগুলো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রক। বিশেষ করে প্রয়োজন একটি ভয়াবহ বিষয় যা বোধকে ঘুম পাড়িয়ে মূল্যবোধের তালায় চাবির মতো কাজ করে বেশির ভাগ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষকে ভাঙে এবং মানুষের সাংগঠনিক অবস্থান অনুযায়ী তাকে নতুন করে তৈরি করে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি সত্য, বস্তুর প্রতি বিশ্বাস ও সংস্কারকে প্রয়োজন ও পরিস্থিতি এ দুটি প্রত্যয় মিলে কিছু সময় পর আবার পুনরায় নবপ্রতিষ্ঠা দান করে। তাই ব্যক্তির পক্ষে উচিত হচ্ছে অন্যের বলা বিষয় বা অন্যের দ্বারা চর্চিত বিষয়গুলো স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং সবার আগে নিজের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোকে নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভাবা। 

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষ যদি পরিশোধন প্রক্রিয়ায় নিজের পরিবর্তনের জন্য কাজ না করে তবে জ্ঞান তার কাছে অধরা থেকে যাবে অনেক ক্ষেত্রে।  কারণ জ্ঞান সীমার ভেতর থেকে মানুষকে অসীমের দিকে টেনে নেয়৷

আপেক্ষিকতা ও প্রয়োজনের জায়গা থেকে বিচার করলে পৃথিবীতে কোনো কিছুরই মূলত স্থায়িত্ব নেই। যা কিছু স্থির, তার অনেকটাই বাধ্যবাধকতার নিষ্ক্রিয়তায় স্থিত। 

স্বভাবগতভাবে মানুষ পরিবর্তন বিমুখ। কারণ পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে অস্তিত্বহীনতাকে উসকে দেয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে যুদ্ধরত। তাই পরিবর্তন বা পরিস্থিতির অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু প্রকৃতির ধর্ম গতি, গতির ধর্ম পরিবর্তন।

মানুষ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে সবাই একত্রে থাকার জন্য।  কিন্তু ব্যক্তি মনের পরিবর্তিত প্রয়োজন অনুযায়ী সে সমাজই কারো কারো একক প্রতিষ্ঠার রক্ষক হয়ে পড়ে। এমনভাবে ব্যক্তি বৃহৎ কাজে যুক্ত হয় মহৎ হয়ে ক্ষুদ্রের স্বার্থকে বিনা বাধায় রক্ষা করার জন্য, কিন্তু সে বৃহতের ক্ষমতা ক্ষুদ্রের স্বার্থ রক্ষার বদলে পরিস্থিতি ও প্রয়োজনভেদে পরিবর্তিত হয়ে ক্ষুদ্রকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে পড়ে। 

আমাদের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যা কিছু স্থিতিশীল তার পেছনে ক্রিয়াশীল মানুষের অপারগতা ও বাধ্যবাধকতা। এটি আমরা স্বীকার করি আর না করি, সত্য এখানে একসূত্রে এসে মেলে৷ সত্য ও সুন্দর মানুষের জীবনে সময় ও পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয়৷

পরিস্থিতি ও সময় প্রয়োজনের পোশাকে মানুষকে নিজেরই বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। আর বেশির ভাগ মানুষই হাসিমুখে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন সাপেক্ষে নিজের জায়গা ও অবস্থা বদল করে নেয়। এতে নিয়ম সংশোধিত হয়। প্রথা বিলুপ্ত হয়। আদর্শ সংস্কারমুক্ত হয়। এমতাবস্থায় কোনো বিষয়েই কি মানুষের দৃঢ়ভাবে অনড় বক্তব্য প্রদান করা উচিত?

উচিত হয়ত নয়, কেননা ধ্রুব বলে গতিশীল পৃথিবীতে বেশি কিছু নেই। প্রতিযোগিতার বাজারে সত্য সাময়িকের, সব সময়ের নয়। আমাদের আচরণ-বিচরণ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, বিশ্বাস, আদর্শ, গ্রহণযোগ্য, বর্জনীয়, প্রত্যাশা ও প্রার্থনা ইত্যাদি সব কিছুই পরিবর্তনশীল। আমরা জেনেও তা না জানার ভান করি, দেখেও না দেখে এড়িয়ে চলি। এই পরিবর্তনবিমুখতা দিনশেষে আমাদের সংকটে ফেলে বিপদের চেয়ে বেশি। আমরা ব্যক্তিগত বা সামাজিক জায়গা থেকে বিষয়গুলো মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে জীবনে চলার প্রস্তুতি নেই না বলেই অন্তর্গত জটিলতাগুলো বৃদ্ধি পায় ক্রমাগত। 

আরেকটি বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। সেটি হলো বিষয়ের স্থিতিস্থাপকতা ও বিষয়ের গুরুত্বের মাত্রার পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে আমাদের উদাসীন ভাব।

এ উদাসীন ভাবের কারণে আমরা নিজের জন্য বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্রোত যেদিকে যায় সেদিকেই নিজের চিন্তাকে কাজে না লাগিয়ে ভাসতে থাকি। এটি মনেই করি না যে তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করাটা সঠিক নাও হতে পারে। আর তাই বস্তুর সাময়িক একচেটিয়া গুরুত্বের দিকে ঝুঁকে আমরা অন্যান্য বস্তুকে যেমন সাময়িকভাবে হলেও গুরুত্বহীন করে দেই, তেমন না বুঝেই স্রোতে গা ভাসিয়ে বস্তুকে প্রয়োজনের পরিবর্তনশীলতার সত্যকে অগ্রাহ্য করে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এটি ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আমাদেরকে ক্ষতির সম্মুখীন করে।

ব্যক্তির তাই বস্তুর প্রয়োজনীয়তার স্থিতিশীলতার ধারণা সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে জানা ও বোঝার প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন। কারণ কোনো বস্তুই গুরুত্বহীন নয় এবং কোনো বস্তুর প্রয়োজনীয়তাই সময়, পরিস্থিতি ও আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে নয়। গুরুত্ব বা গুরুত্বহীনতা কোনোটিই অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। এটি প্রয়োজনের উপর নির্ভরশীল। আর প্রয়োজন নির্ভরশীল সময় ও পরিস্থিতির উপর। এটি অনুধাবন করতে পারলে বস্তুর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, বস্তু সম্পর্কে ব্যক্তি নিজের ধারণা, মনোভাব ও মন্তব্য বা অভিমতকে সময় সাপেক্ষে শিথীলতার বিশেষণে বিশেষায়িত করে পরিবর্তনের সার্বজনিত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। জ্ঞানের নতুন নতুন উৎসকে আবিষ্কার করতে পারবে। কেননা এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থির বা স্থিতিস্থাপক নয়। তবে ব্যতিক্রম যেমন উদাহরণ নয়, তেমনি চিরন্তন সত্য দর্শনও বস্তুর স্থিতিশীলতার আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়। পরিবর্তনকে মেনে নেওয়ার মানসিকতাই হোক মুক্তির উপায়।

লেখক: শারমিন সুলতানা, শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম