মাঝে-মধ্যে মনে হয় আমি অন্যায় করেছি নিজের সঙ্গে, পাঠকের সঙ্গে - হেলাল হাফিজ
রাকিবুজ্জামান লিয়াদ
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
৭ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনায় জন্ম নেওয়া বাংলা সাহিত্যের পাঠকনন্দিত কবি হেলাল হাফিজ ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর অগণিত পাঠকের হৃদয় ভেঙে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। মাত্র দুটি কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ও ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ লিখে লাখো পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় শুরু করেন। সর্বশেষ দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন। লেখালেখির জন্য ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় লেখা তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গতিশীল করতে দারুণ ভূমিকা রাখে। এ কবিতার জনপ্রিয়তম প্রথম দুটি লাইন ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।
হেলাল হাফিজ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কবিতাটি কোনো পত্রিকা প্রকাশ করতে সাহস পায়নি। আহমদ ছফা ও হুমায়ুন কবির কবিতাটির প্রথম দুটি ছত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে লিখে দিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক এ কবিতা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং এ ছত্র দুটি সেসময় রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়।’ কবির মৃত্যুর কিছু মাস আগে ‘সুপার হোম হোটেল’-এ সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো- বি.স। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : রাকিবুজ্জামান লিয়াদ
লিয়াদ : কেমন আছেন?
হেলাল হাফিজ : শরীরটা বেশি ভালো নেইা। এ যে তুমি, তোমার সঙ্গেই কথা বলতে কেমন নিশ্বাস জমে যাচ্ছে। তুমি তো জানো আমার শ্বাসকষ্ট আছে। ইদানীং চোখের সমস্যাও বাড়ছে।
হেলাল ভাই, আপনার বাড়ি নেত্রকোনায় তে, অনেক দিন যান না। কোনো বিশেষ অভিমান?
: অনেক দিন যাই না। না যাওয়ার কোনো বিশেষ অভিমানও নেই। মায়ের সঙ্গে সন্তানের অভিমান তো থাকতেই পারে, তবে বিশেষ না। নেত্রকোনাকে আমি বোনও ডাকি, চোখ বন্ধ করে আমি তাকে দেখতে পাই। আমার লেখা ‘নেত্রকোনা’ কবিতা পড়লেই বুঝবে সব।
হ্যাঁ, ভাই
কিছু কথা অকথিত থেকে যায়
বেদনার সব কথা মানুষ বলে না,
রমণী-কাতর সবিতা সেনের সুতি শাড়িও জানে না
সোনালি অনল আর কত জল দিদির ভেতর।
নেত্রকোনা কবির এ অংশে সবিতা সেন নামে নারী চরিত্র পাওয়া যায়। তিনি কে?
: তিনি আমার কাব্যের নায়িকা। আমি প্রথম প্রেমে পড়ি তার। তিনিই তো আমার সবিতা মিস্ট্রেস। আমার থেকে বারো-তেরো বছরের বড় ছিলেন। তাকে দেখলে আমার মায়ের মতো মনে হতো। আমাকে অসম্ভব আদর-যত্ন করতেন। কখনো মনে তো আমি তার ভাই, আবার মনে হতো প্লেটোনিক প্রেমিক। তিনি আমার মতো মাতাহারা এ মানুষটিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমার প্রথম প্রেমিকা, কবিতার নায়িকা।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিতা নিয়ে বলতে চাচ্ছি না। অনেক জায়গাতে বলছেন আপনি এর বিষয়ে। আমার শুধু একটাই জানার ইচ্ছা। ‘কবিতা একাত্তর’ নামে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সেটাকে আপনি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ বলছেন না কেন?
: কারণ, এখানে ৫২টি কবিতা আমার আগের কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। শুধু পার্থক্য, এটি ইংরেজিতেও লেখা হয়েছে। তাই আমি এটাকে মৌলিক কাব্যগ্রন্থ বলতে রাজি নই। তবে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’-এটাও তো আমার মৌলিক বই। এখন তো বলতেই পারি আমার মৌলিক বই দুইটা। হাহাহা...
কবিতা আসলে আপনাকে কী দিয়েছে?
: কবিতা আমাকে ‘হেলাল হাফিজ’ বানিয়েছে। একটা পরিচিতি পেয়েছি। কিন্তু আমার সবসময়ই মনে হয়, সে তুলনায় আমি কিছুই দিতে পারিনি। মাত্র দুটি বই। ভাবো একবার। মাঝে-মধ্যে মনে হয় আমি অন্যায় করেছি, নিজের সঙ্গে, পাঠকের সঙ্গে। মাথায় কত কিছু আসছে, কিন্তু লিখতে সাহস হয়নি। যদি ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র মতো না হয়? আমাকে যদি গ্রহণ না করে মানুষ? কবিতা দিয়ে সবাই জমায় টাকা, আমি চাই মানুষ জমাতে। এ জমানো মানুষকে হারাতে চাইনি। তবে এখন ভাবি, উচিত ছিল আরও কিছু করার। আমি একটি ঘটনা তোমাকে বলি। তাহলেই বুঝবে আমি কবিতা লিখে কী পেয়েছি। একবার সিলেটের একটি কবিতার অনুষ্ঠান। তারা কিন্তু মহাপ্রাণ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। ভালোবাসা হয়ে যায় বালোবাসা। যাহোক, অনুষ্ঠানের পরে, এক ভদ্রলোক আরেকটি ছেলের হাত ধরে আমার কাছে এলেন। তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। আমার হাতটা ধরে বললেন, ‘ভাই আমি তো জন্মান্ধ, কিন্তু দুটি জিনিস আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, আমি যখন আমার অর্ধাঙ্গিনীকে...’। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনি অর্ধাঙ্গিনী বললেন কেন? আপনি স্রষ্টাঙ্গিনী বলতে পারলেন না?’ সঙ্গে সঙ্গে উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘আমি অন্ধ হয়েও আমার সহধর্মিণীর শরীরে আঙুল দিয়ে দেখতে পারি, কোন জায়গাটা অধিকতর ফরসা, কোন জায়গাটা অধিকতর কালো। আরেকটা জিনিস আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। ওই যে আপনি বলেছেন, ‘পাথরচাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট’-ওই সাদাটাও আমি দেখতে পাই। এটা শুনে আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এলো।
আপনাদের শুরুর সময় কবিদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল?
: আবুল হাসানের সঙ্গে। আমাদের মধ্যে সে-ই তখন সবচেয়ে ভালো লিখত।
সাহিত্যের শুরু কার হাত দিয়ে? আপনার কবি হওয়ার পেছনে কীসের প্রভাব ছিল?
: আব্বা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। সে সুযোগে আমি ছোট থেকে বই পড়ি। কবি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব মাতৃহীনতা! যখন আমার তিন বছর বয়স, আমার মা মারা যান। ছোটবেলায় মা হারানোর বেদনাটা আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে। ধীরে ধীরে মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরল, আমি আর এটা থেকে বের হতে পারলাম না।
বিয়ে করেননি কেন?
: দীর্ঘ জীবন পেলাম। এ দীর্ঘ জীবনের পেছন ফিরে তাকালে তিনটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। তিনটি ঘটনাই আমার জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। আমি সফল নাকি ব্যর্থ, হিসাব কষতে বসলেও ওই তিনটি ঘটনা অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে। প্রথম ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকি। ওইদিন সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের দিকে আড্ডা দিয়ে রাতে হলে ফিরেছি। ক্যান্টিন বন্ধ। খেতে গেলাম মেডিকেল গেটের কাছে পপুলার নামের একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া শেষে মনে হলো, ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবীবুল্লাহ থাকে, ওর সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। গেলাম ফজলুল হক হলে। হাবীবুল্লাহর কক্ষে গিয়ে আমি আড্ডা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর, রাত তখন পৌনে ১০টা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির বিকট আওয়াজ। আমরা হলের ছাদে উঠে দেখলাম, নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।
এ ঘটনা আমার হৃদয়ে ব্যাপকভাবে ছাপ ফেলল। আমার তখন কেবলই মনে হতো, ওই রাতে যদি আমি ফজলুল হক হলে না গিয়ে নিজের হলে ফিরতাম, তাহলে তো বাঁচতাম না। একটা বোনাস জীবন পেয়েছি-এ উপলব্ধি আমার ভেতর বিরাট বৈরাগ্য এনে দিল। এক ধরনের সন্ন্যাস জীবনযাপন শুরু করলাম আমি।
এর পরের ঘটনা ’৭৩ সালের ১৯ জুনের, আমার পিতার মৃত্যু হলো। তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর আব্বাই ছিলেন আমার সবকিছু। তার মৃত্যু প্রবলভাবে ধাক্কা দিল আমাকে। মনে হলো, জগৎ-সংসার তুচ্ছ। সব অর্থহীন। আমার বৈরাগ্য আরও প্রগাঢ় হলো।
আব্বার মৃত্যুর মাসখানেক পরই ঘটল তৃতীয় ঘটনা। ঘটনা ঘটাল হেলেন, আমার প্রেমিকা। হেলেন হঠাৎ ডেকে বলল, ‘কবি, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ আমরা গিয়ে বসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। সে বলল, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’ ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। তাই ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে গেলাম। ওটাই হেলেনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।
এ তিনটি ঘটনা আমাকে চিরস্থায়ীভাবে সংসারবিমুখ করে ফেলল। আমার আর ঘর হলো না, সংসার হলো না, অর্থকড়ি হলো না, প্রতিষ্ঠা হলো না।
এখন এ হোটেল জীবনে মনে হয় না যে বিয়ে করা উচিত ছিল?
: এ বয়সে এসে মনে হচ্ছে কথা বলার কাউকে দরকার। একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করছে।
’৭৩ সালের ১৯ জুনে আপনার পিতার মৃত্যু হয়। ওনাকে তো সবাই ‘পাগড়িওয়ালা স্যার’ বলতেন। ওনার সম্পর্কে জানতে চাই
: আমার বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার নিজে কবি ছিলেন। আবার ধর্মকর্ম করতেন। তার ৮-১০টি বিভিন্ন রঙের পাগড়ি ছিল। পাগড়ি পরতে তিনি পছন্দ করতেন। এজন্য আমার স্কুলশিক্ষক বাবার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘পাগড়িওয়ালা স্যার’।
আপনার পরিবারির জীবনের কথা কিছু বলুন
: আমার আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করেন আমার মা মারা যাওয়ার চার বছর পর। আমার আব্বার জন্য পাত্রী কিন্তু আমিই পছন্দ করেছি। আব্বা বলেছিলেন, ও যাকে পছন্দ করবে, তাকেই বিয়ে করব। আমি বরযাত্রীও হয়েছিলাম। নিজে বিয়ে করতে পারিনি বটে, আব্বাকে তো বিয়ে করিয়েছি। আমার আপন এক ভাই আছে। সৎমায়ের ঘরে তিন বোন, দুই ভাই আছে। সৎমা বেঁচে নেই। আমি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ছিলাম নেত্রকোনায়। সৎমায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো-মন্দ মিলিয়েই ছিল। কম বয়স ছিল যখন, তখন মনে হতো সৎমা বুঝি খুবই খারাপ। এখন মনে হয়, ব্যাপারটা একতরফা ছিল না। আমারও দোষত্রুটি ছিল।
আপনি খুব ভালো জুয়া খেলতেন, জুয়া খেলায় জয়লাভের আর কোনো গোপন কথা আছে কি, আসল ট্রিক্সটা কী-ফাঁস করা যায়?
: হাহাহা...। চিকন কারণ আরও একটা আছে। সবাই কার্ড খেলাকে নেয় খেলা হিসাবে। আমি নিয়েছিলাম জীবিকা হিসাবে। অবশ্য আমার সামনে অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করায় আমার সব মনোযোগ, দিবারাত্রির চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা ছিল ওই একটা বিষয়েই। তা হলো, কীভাবে জেতা যায়! এসব মিলিয়ে ব্যাপারটা দুর্দান্তভাবে ক্লিক করে গেল।
জীবন নিয়ে কোনো অভিযোগ আছে?
: খুব বেশি নেই বললেই চলে। বড্ড অকিঞ্চিৎকর মানুষ আমি। মারাত্মক এক স্বপ্ন নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম। আমার স্বপ্নের দন্তস্যর নিচে ব-ফলা ছিল না। তিন বছর বয়সে আঁচল উধাও হয়ে গিয়েছিল। সবার জীবনেরই একটা গল্প আছে। আমার ধারণা, আমার জীবনের চেয়ে বাকি সব মানুষের গল্প আরও মর্মান্তিক।
মৃত্যুর পর আপনার কবর কোথায় আশা করেন?
: এটি সময়ের বিষয়। এটি না বলি। সময় আমাকে যেখানে রাখে, সেখানেই। তবে আমার ইচ্ছা দেহ দান করে দেওয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে লাগুক। আমি তাই চাই। কিন্তু এটি তো চাইলেই হবে না। কাগজ করে দেওয়া দরকার। লিখে রেখে যেতে চাই।
ধন্যবাদ আমাকে সময় দেওয়ার জন্য
: তোমাকেও ধন্যবাদ প্রিয়, ভালো থেকো সব সময়