বাংলাদেশের সাহিত্য মধ্যবিত্তের দ্বারা, মধ্যবিত্তকে নিয়ে এবং মধ্যবিত্তের জন্য রচিত: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ২৩ জুন, ১৯৩৬। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটর ডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একশর ওপরে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে তিনি বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক।
প্রায় দুই যুগ ধরে সম্পাদনা করছেন ‘নতুন দিগন্ত’ নামের ত্রৈমাসিক পত্রিকার। সম্প্রতি শিক্ষা সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। সে আলোচনার অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো। বি. স। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জুননু রাইন
শিক্ষাব্যবস্থা সমাজকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষার কাজটি করতে পারছে?
: শিক্ষাব্যবস্থা বরং সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিন ধারার শিক্ষা। শিক্ষার তিন ধারায় বিভাজন সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি বিভাজনের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। কথা ছিল শিক্ষার কাজ চলবে এক ধারায় এবং মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তিন ধারা পরাধীনতার যুগেও ছিল; স্বাধীনতাকালে তার অবসান ঘটবে, এটাই ছিল কাম্য। সেটা ঘটেনি। বরং তিন ধারার ভেতর দূরত্ব আরও বেড়েছে। যার সরল অর্থ দাঁড়ায় এটা যে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শিক্ষা ঐক্য আনবে কী, বৈষম্যই বাড়িয়ে তুলছে। এমনকি মূলধারার যে শিক্ষা সেখানেও অর্থাভাবে ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটছে এবং অভিভাবকদের আর্থিক সঙ্গতির ওপর শিক্ষাগ্রহণের ক্ষমতার বাড়তি-কমতি নির্ভর করছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে বৈষম্য দূর না করে বাড়ানোর কাজেই নিয়োজিত।
আগের শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে আবার নতুন শিক্ষাক্রমের চিন্তা করছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রম কেমন হওয়া উচিত?
: শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাসূচি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর কোনোটাই সুফল আনেনি, অথচ এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমানে চলছে, সরকারগুলো তাদের মহিমা প্রচারের জন্যই এসব করে। ইংরেজি মাধ্যমে কিন্তু এসব ব্যাপার নেই। সেখানে হস্তক্ষেপ নেই। মূলধারা নিয়েই যত টানাহ্যাঁচড়া। এর একটা কারণ মূলধারায় সুবিধাভোগীদের সন্তানরা পড়ালেখা করে না, তারা চলে যায় ইংরেজি মাধ্যমে। ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি কেন আনা হয়েছিল, কেনইবা বাতিল হলো তা আমরা জানি না। পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কেন বাড়ানো হলো আবার কেনই-বা কমানো হলো তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। নতুন যে শিক্ষাক্রম চালু করার কথা চলছিল সে ব্যাপারেও কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে উলটো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে যদি বদল আনতেই হয় তবে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা কোনো বিদেশি ভাষা শিখবে না, এমত ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা কারিগরি কোন শিক্ষা নেবে সেটা আগের মতোই নবম শ্রেণিতে নির্ধারণই শ্রেয়। সর্বোপরি গুরুত্ব দিতে হবে উপযুক্ত শিক্ষক সংগ্রহের ওপর। তার জন্য শিক্ষকদের বেতন, ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় পেশা হিসাবে দাঁড় করানো দরকার, মেধাবানরা যাতে আকৃষ্ট হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষিতের নামে একশ্রেণির প্রশিক্ষিত লোক তৈরি করছে-যারা রাষ্ট্রে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী থাকতে পারার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেবে। এমন যদি চলতে থাকে মানুষের সামাজিক অবস্থান ভবিষ্যতে কেমন হতে যাচ্ছে? এ থেকে বেরোনোরই বা পথ কী?
: শিক্ষার্থীরা কারিগরি যন্ত্র নয়, তারা মানুষ। তাদের মনুষ্যত্ব বিকাশ ও সংরক্ষণের শিক্ষা দেওয়া চাই। মানুষ মানুষ হয় সামাজিকভাবে, তাই শিক্ষা কেবল দক্ষতা দেবে না, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মানুষ গড়ে তুলবে এটাই হওয়া চাই লক্ষ্য। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকা চাই। চাই পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য পাঠেও উৎসাহ দান। শিক্ষা দিতে হবে ইতিহাস এবং প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়েও। শিক্ষা চাই যেমন বুদ্ধির তেমনি হৃদয়ের। বর্তমানে যা চলছে তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। শিক্ষার মান তো নামছেই, গুণও সংকুচিত হয়ে এসেছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার; আর সেই বরাদ্দ যে যথার্থভাবে খরচ হচ্ছে তার তদারকি আবশ্যক। মূলকথা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া চাই, যেটা দেওয়া হচ্ছে না।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ভালো-খারাপ কী হতে পারে?
: রাজনীতি নয়, বন্ধ করা চাই দলবাজি। বিশেষভাবে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা প্রয়োগ ও চাঁদা তোলার সংস্কৃতিটা ভেঙে ফেলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই, কলেজেও ছাত্র সংসদের নিয়মিত নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকা দরকার যার মাধ্যমে সমাজের সব ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির অনুশীলন ঘটবে। মানুষ রাষ্ট্রের ভেতরেই বসবাস করে, তাই রাজনীতি থাকবেই এবং রাজনীতির ব্যাপারে জ্ঞান ও রাজনৈতিক ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে থেকেই অর্জন করা আবশ্যক। ওই জ্ঞান ও বোধ না থাকলে পরিপূর্ণ মানুষ তো নয়ই, সুনাগরিকও গড়ে উঠবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা বর্তমান ও ভবিষ্যৎমুখী? নাকি এখানকার রাজনীতি মিথের কঙ্কাল ভাঙিয়ে চলে? আমি কথাটা বামসহ সব রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ মাথায় রেখে বললাম।
: রাজনীতিতে দল অনেক, কিন্তু ধারা দুটি। একটি ধারা বুর্জোয়াদের, অপরটি সমাজবিপ্লবীদের। আমাদের দেশে বুর্জোয়া রাজনীতিই প্রধান, কারণ বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক। বুর্জোয়া রাজনীতি বলতে কেবল সেকুলার ও তথাকথিত উদারনৈতিক রাজনীতিই বোঝায় না, ধর্মকে ব্যবহার করার যে রাজনীতি সেটাও কিন্তু বুর্জোয়া রাজনীতিই। বুর্জোয়ারা ব্যক্তি মালিকানায় ও ব্যক্তি মুনাফায় বিশ্বাস করে; এবং পুঁজিবাদী ওই ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যই রাজনীতি করে থাকে। তাদের রাজনীতি অতীতমুখী হতে বাধ্য; কারণ যা অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও রয়েছে তাকেই তারা রক্ষা করতে ও শক্তিশালী করতে চায়। সমাজবিপ্লবীদের রাজনীতি সম্পদের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চায়; যেটা অতীতে ছিল না, বর্তমানেও নেই; তাই তাদের রাজনীতি হওয়া দরকার ভবিষ্যৎমুখী। ভবিষ্যতে সামাজিক মালিকানার জগৎ গড়ে তুলবে এটাই হওয়া চাই লক্ষ্য। সমাজবিপ্লবী রাজনীতি অতীতের মোহাবিষ্ট নয়, উন্নত ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। দুঃখের বিষয় ওই রাজনীতি দেশে দুর্বল। বামদল আছে, কিন্তু তারা সবাই যে সমাজবিপ্লবের জন্য দৃঢ়ভাবে সংগ্রামে নিবিষ্ট তা নয়। বুর্জোয়ারা অতীত নিয়ে ব্যবসা করবেন, সমাজবিপ্লবীরা মানবিক ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য কাজ করবেন, এমনটাই হওয়া দরকার ছিল। রাজনীতির ক্ষেত্রে সমাজ-পরিবর্তনের রাজনীতিই প্রধান ধারা হবে, মানুষ এমনটাই আশা করেছিলেন।
বাংলাদেশের সাহিত্য কি এখনকার মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনকে গভীরভাবে রূপায়িত করতে পেরেছে? নাকি আরোপিত জীবন পদ্ধতির কারবারি এ সাহিত্য? যদি তাই হয়, তাহলে কেন এমন হয়?
: বাংলাদেশের সাহিত্য মধ্যবিত্তের দ্বারা, মধ্যবিত্তকে নিয়ে এবং মধ্যবিত্তের জন্য রচিত। সমষ্টিগত জীবনকে যথোপযুক্ত রূপে ধারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা। কোনো সাহিত্যই যথার্থ সাহিত্য হয় না যদি তা দার্শনিক না হয়। দর্শন বলতে ইতিহাস, অর্থনীতি, প্রকৃতি-পরিবেশ, মতাদর্শ সব কিছু নিয়ে সামগ্রিক চিন্তাকে বুঝতে হবে। সাহিত্যে অনুভূতি থাকে, কিন্তু কেবল অনুভূতি দিয়ে সাহিত্য মহৎ হয় না। মহৎ হওয়ার জন্য দার্শনিকতা চাই। এ দার্শনিকতা কেবল যে জ্ঞানের ব্যাপার তাও নয়, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারও বটে। জ্ঞানের অর্জন ও প্রয়োগ দুটোই নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সাহিত্যের কাজগুলো খুব কী বিষয়ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে না? এই যেমন ধরুন, ব্রিটিশবিরোধিতা, পাকিস্তান বিরোধিতা, বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা এবং অতিসম্প্রতি ভারত বিরোধিতা..., সাহিত্যে এসব নিয়েই বেশি কাজ হচ্ছে বা হতে হচ্ছে। মানুষের জীবনের চেয়ে আমাদের সাহিত্যে ব্যক্তির রাজনৈতিক অস্থির জীবন নিয়েই বেশি কাজ হচ্ছে বা হতে হয়েছে। এতে আমরা জীবনের অতল গহিন দর্শনের চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি না তো? আমরা এখন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ বা ‘পথের পাঁচালী’র মতো সাহিত্য-কর্ম পাচ্ছি না...। এ সংকট আমাদের সাহিত্যকে নিষ্প্রাণ করে দিচ্ছে না তো?
: মানুষের জন্যই সাহিত্য; এবং মানুষের জীবনকে নিয়েই তার সৃষ্টি। কিন্তু সাহিত্য কেবল জীবনকে চিত্রিতই করে না, জীবনকে বুঝতেও সাহায্য করে। সে জন্য সাহিত্যে পূর্ণ জীবন পাব এটাই প্রত্যাশা। যে দুটি উপন্যাসের নাম করলেন সে-দুটিতে কিন্তু অর্থনীতি এবং সমাজ উভয়েরই উপস্থিতি রয়েছে। অর্থনীতি ও সমাজকে বাইরে রেখে সাহিত্য ভাসমান ছবি হতে পারে, প্রকৃত সাহিত্য হবে না। প্রকৃত সাহিত্য সহানুভূতির সৃষ্টি করে, এবং সেই সহানুভূতি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বদলানোর পক্ষে কাজ করে। সাহিত্য সব সময়ই মানবিক; সাহিত্যচর্চা করে মনুষ্যত্বের, এবং মনুষ্যত্ব নির্ভর করে সহানুভূতি ও চিন্তার শক্তির ওপর; স্বার্থপরতার ওপর নয়। সাহিত্য স্বার্থপরতা শেখায় না, শেখায় নিজেকে অতিক্রম করে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হতে। সে জন্যই সাহিত্যের দর্শনচর্চা দর্শনের সাধারণ চর্চা থেকে ভিন্ন। দর্শনের সাহিত্যিক চর্চা জীবন ও জগৎকে কেবল জানতে ও বুঝতেই চায় না, বদলাতেও চায়।
বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে অল্প কিছু লেখক এসেছেন, যারা যা লিখেছেন সে আদর্শে বাস্তব জীবনেও কাজ করে গেছেন। এ দুটোর সমন্বয় খুব বিরল। আপনি সেই বিরলদের অন্যতম। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ লেখককেই দেখতে পাই তারা যা বিশ্বাস করেন, যা লেখেন, বাস্তব জীবনে বা তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তা নিয়ে সক্রিয় থাকেন না। এটা কেন হয়ে থাকে?
: সাহিত্যিক নিজে কিন্তু রাজনৈতিক বা সমাজকর্মী নন, যদিও সাহিত্য রাজনীতিকে ও সমাজ বদলকে অবশ্যই; এবং চরিত্রগতভাবেই, সাহায্য করে থাকে। একজন সাহিত্যিক যদি যা লেখেন তাতে বিশ্বাস না করেন তবে তিনি তো সাহিত্যিকই নন, তিনি একজন মিথ্যাবাদী। সাহিত্য কিন্তু মিথ্যাকে পছন্দ করে না, যদিও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার উপস্থাপন ভিন্ন রকমের-অর্থাৎ নান্দনিক। সাহিত্য মত প্রকাশের যন্ত্র নয়, কিন্তু সাহিত্য সব সময়ই কোনো না কোনো মত প্রকাশ করে থাকে। অন্য সব মানবিক বিষয় যেমন সাহিত্যও তেমনি, কখনোই নিরপেক্ষ নয়। সহানুভূতি পক্ষপাতেরই নিদর্শন বৈকি। এবং সাহিত্যকে শৈল্পিক হতে হয়, কিন্তু শিল্পকলা মিথ্যাচারী নয়, সত্যবাদী। এমনকি কোনো সাহিত্যিক নিজে যদি মতাদর্শিকভাবে প্রগতিবিরোধী হন তাহলেও কিন্তু তার লেখা প্রগতির পক্ষে যেতে পারে, যদি তাতে বাস্তবিক সত্যের উন্মোচন থাকে; তখন দেখা যাবে যে পাঠক লেখকের উদ্দেশ্যের বিপক্ষে চলে যাচ্ছেন। সত্যিকারের সাহিত্য লেখকের আজ্ঞাবহ নয়!
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মিডিয়া এখন যেটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে, সেটা রক্ষা করার জন্য মিডিয়াগুলোর করণীয় কী?
: মিডিয়ার পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন খুবই কঠিন কাজ। রাষ্ট্র তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, মালিক তাকে চোখে চোখে রাখে। অনেকটা সময় ধরে মিডিয়ার কণ্ঠ চেপে রাখা হয়েছিল। চোখ ছিল, তবে দেখেও দেখতে পেত না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে মনে হচ্ছে মিডিয়া আপেক্ষিক স্বাধীনতা কিছুটা পেয়েছে। কিন্তু মিডিয়ার মালিকরা আছেন, যারা বিজ্ঞাপন পেতে পছন্দ করেন, অন্যকিছু বাদ দিয়ে। মিডিয়ার জন্য স্বাধীনতার পরিসরটা বাড়াতে পারেন আসলে মিডিয়ার কর্মীরা। তারাই চাপের মধ্যে রাখতে পারেন মালিকপক্ষকে, এবং রাষ্ট্রকেও। কিন্তু তার জন্য যেটা দরকার হবে সেটা হলো মিডিয়া-কর্মীদের ঐক্য। যেটা নেই। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখলেই শুধু চলবে না, সমষ্টিগত স্বার্থও দেখতে হবে। সেটা দেখলে নিজেদের মানসম্মান বাড়বে, কাজে চরিতার্থতা আসবে। দেশের মানুষের উপকার হবে। এটা খুবই দুঃখজনক সত্য যে মিডিয়া-কর্মীরা দলীয়ভাবে বিভক্ত। পেশাগত স্বার্থে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া চাই। পাকিস্তান আমলে দেখতাম পূর্ববঙ্গের সাংবাদিকরা তো বটেই, পাকিস্তানজুড়েও সাংবাদিকরা নিজেদের অধিকার তথা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতেন। ওই ঐক্যটা এখন খুবই প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ধরা হয় বেকার সমস্যা মোকাবিলা। এ বেকার সমস্যা মোকাবিলা এবং দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
: বেকার সমস্যা ভয়াবহ রকমের একটি চ্যালেঞ্জ বৈকি। সমস্যাটা কমছে না, বাড়ছেই। এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। অর্থনীতিতে যে উন্নতি হচ্ছে সেটা পুঁজিবাদি ধরনের। তাতে মালিকের মুনাফা আসছে, কিন্তু কর্মের সংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উন্নয়নের প্রকল্পগুলো হওয়া চাই শ্রমঘন। সে-উন্নতি মোটেই উন্নতি নয়, যে-উন্নতি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে না, এবং যার উপকার দেশের মানুষ পায় না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা দরকার। সমবায়ী ও যৌথ উদ্যোগ চাই। ব্যাংকের ঋণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজলভ্য করা আবশ্যক। কিন্তু সেটা তো ঘটছে না।
ব্যাংক লুণ্ঠিত হচ্ছে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের দ্বারা। তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। উন্নতি ভূতের মতো অদ্ভুত নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে দৈত্যের মতো দানবীয়; হওয়া দরকার ছিল নদীর মতো সর্বত্র প্রবহমান ও সৃষ্টিশীল। আসলে বাংলাদেশে যা ঘটেনি, কিন্তু যা অত্যাবশ্যকীয় তা হলো একটি সামাজিক বিপ্লব, যাতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব চলে আসবে জনগণের কাছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার বন্ধ হবে না, বৃদ্ধি পাবে দেশপ্রেম, এবং মুক্ত হবে মানুষের সৃষ্টিশীলতা। সেটা ঘটছে না, রাষ্ট্র শাসকেরা তাকে প্রতিহত করছেন। অর্থনীতিকে পুঁজিবাদের অধীনে রেখে মানুষের মুক্তি যে অসম্ভব তার প্রমাণ আমরা প্রতিদিন পাচ্ছি। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী, কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না, শ্রমিক বঞ্চিত হন বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মজুরি থেকে। অবস্থা দুঃসহ।