
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪৮ এএম
ব্যথার ওষুধ ‘অ্যাসপিরিন’ যেভাবে ক্যানসারের বিস্তার রোধ করে
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:০৮ পিএম

আরও পড়ুন
দীর্ঘদিন ধরে অ্যাসপিরিনকে কার্যকর ব্যথানাশক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। তবে এটি ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও সহায়ক হতে পারে বলে নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে।
আগের গবেষণাগুলোতে অ্যাসপিরিন ব্যবহারের ফলে ক্যানসার রোগীদের বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, তবে এর সঠিক কারণ অস্পষ্ট ছিল। সম্প্রতি ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা এটির পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, অ্যাসপিরিন কোনো ক্যানসারের নিরাময় নয়—এটি অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের মতো ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
তাহলে কিভাবে অ্যাসপিরিন ক্যানসারের বিস্তার রোধ করতে পারে এবং এর ফলে ভবিষ্যতের চিকিৎসায় কী পরিবর্তন আসতে পারে? গবেষণার আলোকে বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
গবেষণায় অ্যাসপিরিন ও ক্যানসারের মধ্যে যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বহুল ব্যবহৃত ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন ক্যানসারের বিস্তার রোধ করতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি সব ধরনের ক্যানসারের জন্য সমান কার্যকর হবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
১৯৮৮ সালে প্রথম ক্লিনিক্যাল গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত অ্যাসপিরিন সেবনে কোলোরেক্টাল (মলদ্বারের) ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। কিন্তু তখন এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন এক গবেষণায় এ রহস্যের সমাধানের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, অ্যাসপিরিন ক্যানসারের মেটাস্ট্যাসিস (শরীরে ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া) রোধ করতে সহায়ক হতে পারে।
ক্যানসারের মেটাস্ট্যাসিস বা ক্যানসার শরীরে ছড়িয়ে পড়ার কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা মারা যান। ক্যানসার কোষ মূল টিউমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন টিউমার তৈরি করে।
এ বিচ্ছিন্ন ক্যানসার কোষগুলো যখন শরীরের অন্যান্য স্থানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে, তখন অ্যাসপিরিন শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তাদের ধ্বংস করতে সাহায্য করতে পারে।
কিভাবে অ্যাসপিরিন ক্যানসারের বিস্তার রোধ করতে পারে?
অ্যাসপিরিনের ক্যানসার প্রতিরোধী প্রভাব শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত।
স্বাভাবিকভাবে যখন ক্যানসার কোষ মূল টিউমার থেকে আলাদা হয়ে রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে, তখন টি-সেল নামে এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা এ কোষগুলোর সন্ধান করে এবং ধ্বংস করে।
কিন্তু প্লাটিলেট (রক্তে জমাট বাঁধার জন্য দায়ী ছোট কোষীয় কণা) এ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে।
ক্যানসার প্লাটিলেটকে কাজে লাগিয়ে একটি প্রতিরক্ষামূলক আবরণ তৈরি করে; যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে (ইমিউন সিস্টেমের) ফাঁকি দেয়।
প্লাটিলেট ক্যানসার কোষের চারপাশে আবরণ তৈরি করে; যা টি-সেলকে তাদের শনাক্ত করতে বাধা দেয়। উপরন্তু, প্লাটিলেট এমন কিছু রাসায়নিক নিঃসরণ করে; যা টি-সেলের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
অ্যাসপিরিন প্লাটিলেটের এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে। ওষুধটি প্লাটিলেটের উৎপন্ন কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক কমিয়ে দেয়, ফলে টি-সেল পুনরায় সক্রিয় হয়ে ক্যানসার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে পারে।
ক্যানসারের চিকিৎসায় কিভাবে অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা যেতে পারে?
গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যাসপিরিন অস্ত্রোপচারের পর ব্যবহার করা যেতে পারে; যখন প্রাথমিক টিউমার অপসারণ করা হয়।
কারণ অস্ত্রোপচারের আগেই কিছু ক্যানসার কোষ শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছোট ছোট কোষগুলো নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করে এবং ভবিষ্যতে টিউমার তৈরি করতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এ গবেষণা এখনই অ্যাসপিরিনকে চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয় না।
অ্যাসপিরিন অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, বিশেষ করে পাকস্থলী ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
এটি রক্তের প্লাটিলেটের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে রক্ত পাতলা হয়ে যায়। এটি পাকস্থলীর আলসার ও মস্তিষ্কে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
এছাড়া এ গবেষণাটি এখনো শুধু ইঁদুরের ওপর চালানো হয়েছে, মানুষের ওপর এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রাহুল রায় চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের গবেষণা ক্যানসারের বিস্তার রোধে অ্যাসপিরিনের ভূমিকা সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেয়, তবে এখনো এটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় নিশ্চিত হতে হবে।’
অতীতে অ্যাসপিরিন যেসব রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়েছে
অতীতে কিছু উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ক্যানসার রোগী অ্যাসপিরিন ব্যবহারের পরামর্শ পান (যেমন লাঞ্জ সিনড্রোম-একটি জেনেটিক অবস্থা)।
এছাড়াও হৃদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য অ্যাসপিরিন ১৯৮০-এর দশক থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অ্যাসপিরিন রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
অ্যাসপিরিন কী ক্যানসারের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলতে পারে?
এটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অ্যাসপিরিন পুরোপুরি ক্যানসার নির্মূল করতে পারে না, তবে এটি বিস্তার রোধে সাহায্য করতে পারে।
গবেষকরা ব্লাড মার্কার ও প্লাটিলেট কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ক্যানসার ঝুঁকি নির্ধারণের পদ্ধতি উন্নয়নে কাজ করছেন।
ক্যানসার গবেষক ডা. পাওলা প্যাট্রিগনানি বলেন, ‘আমরা ক্যানসার গবেষণায় এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। এটি ভবিষ্যতে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির পথ খুলে দিতে পারে এবং অসংখ্য জীবন বাঁচাতে পারে।’
ক্যানসারের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো কেন পাওয়া যায়নি?
ক্যানসারের অনেক প্রকারভেদ রয়েছে; প্রতিটি আলাদা আচরণ করে এবং আলাদা উপায়ে ছড়ায়। ফলে একক কোনো চিকিৎসা সবার জন্য কার্যকর নয়।
এছাড়া ক্যানসার জিনগত ও পরিবেশগত উভয় কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে হবে।
বিভিন্ন ক্যানসার প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা দমন করতে পারে; যা তাদের ধ্বংস করা কঠিন করে তোলে।
এ কারণে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে আরও গবেষণা ও উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন।