Logo
Logo
×

লাইফ স্টাইল

স্পর্শের ভালো-খারাপ, শিশুদেরকে যেভাবে সচেতন করবেন

Icon

লাইফস্টাইল ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০৬ পিএম

স্পর্শের ভালো-খারাপ, শিশুদেরকে যেভাবে সচেতন করবেন

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বড়দের শ্রদ্ধা এবং ছোটদের স্নেহ এই বিষয়টা অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত এক ধরনের বাস্তবতা। সেই জায়গা থেকে শিশুদের আদর করাটাও সামাজিকভাবে বেশ প্রচলিত।

অবশ্য বিশ্বের অনেক দেশেই মা-বাবা ছাড়া অন্য কেউ বা বাইরের কেউ শিশুদের আদর করাকে বেশ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। মা-বাবার অনুমতি ছাড়া এমন ক্ষেত্রে অনেক সময় শক্ত আইনের ব্যবস্থাও থাকে।

এর পেছনে একটা বড় কারণ শিশুদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকি। কারণ সাবধানতা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে শিশুদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে।

যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চার জন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন এবং ২০ জন ছেলেশিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়। এই তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র বা সিডিসির।

সেখানে বলা হচ্ছে এমন এমন হয়রানির শিকার হওয়া ৯০ শতাংশই কোনো পরিচিত বা পরিবারের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের দ্বারা ঘটে।

বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০২৪ সাল জুড়ে ২৩৪টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ৬৬টি। এর বাইরে ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৬টি, ধর্ষণচেষ্টা তিনটি।

শিক্ষক পর্যায় থেকে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৯০টি, অপরিচিতদের দ্বারা ৩৯টি। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি নিবন্ধে গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে নারীদের মধ্যে শতকরা ৩০, পুরুষদের মধ্যে শতকরা ১৬ জন ছোটবেলায় কোনো না কোনো যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

এছাড়া প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারী শিশুর পরিচিত হয়… তার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ, সেই নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসিম জাহান।

তবে এতটা তীব্র পর্যায়ে যাওয়া ছাড়াও স্বাভাবিক স্পর্শ বা আদর করার ক্ষেত্রে যদি তা কোনো শিশুর জন্য অস্বস্তির কারণ হয় তবে সেটা যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পড়তে পারে।

এছাড়া এমন সংবেদনশীল বিষয়ে সামাজিক ট্যাবু বা গোপনীয়তার সংস্কৃতি কম বয়সে নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তির জন্য মানসিক ট্রমার কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

অভিভাবকদের করণীয়

এই ধরনের বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় এমন বিষয় নিয়ে অভিভাবকরা বিবেচনায় নিতে বা আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন। অনেক ক্ষেত্রে জানতে পারলেও পরিবারের কাছের মানুষদের সন্দেহ করার বিষয়েও অভিভাবকরা কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।

অভিভাবকরা যদি এবিষয়ে সচেতনতা না দেখান বা এমন ঘটনা ঘটলে শুধু বিষয়টিকে গোপন রাখার বিষয়ে জোর দেন এবং খারাপভাবে স্পর্শ করা ব্যক্তি যদি পরিবারে অবাধে ওঠাবসা করতে পারেন তাহলে সেটা জীবনভর মা-বাবার ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক মনোভাব বা ট্রমা হিসেবে রয়ে যেতে পারে, বলছেন অধিকারকর্মী নিশাত সুলতানা। তিনি শিশুদের এমন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন এবং বর্তমানে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একজন পরিচালক।

বাংলাদেশে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও বিশ্বের এ সংক্রান্ত বই বা তথ্য বিশ্লেষকদের মতামত দিয়ে ভিডিও বা বুকলেট তৈরি করে। এগুলোয় তুলে ধরা হয় শিশুকে যা যা শেখাতে হয়, একই সঙ্গে অভিভাবককেও যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হয়।

বাংলাদেশে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তেমন বেশ কিছু বিস্তারিত বুকলেট প্রকাশ করেছে। সেখানে অভিভাবকদের যে বিষয়গুলো বলা হয়––

১. শিশুর সঙ্গে একা সময় কাটাতে চাওয়া ব্যক্তির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। অভিভাবক ছাড়া কাউকে, এমনকি শিশুর পছন্দের ব্যক্তির সাথেও বাইরে ঘুরতে দেয়া যাবে না। শিশুদের সঙ্গে ছোট বলে এমন আচরণ মেনে নেওয়া যাবে না যাতে তারা অস্বস্তি বোধ করে।

২. মা-বাবা ও অভিভাবকদের মাথায় রাখতে হবে পরিবারের ভেতরে-বাইরে কারো কারো অন্যের শরীরে খারাপভাবে হাত দেওয়ার অভ্যাস থাকতে পারে। যেসব জায়গায় হাত দেওয়া উচিত না তেমন জায়গায় হাত দিলে শিশুরা যেন মা-বাবাকে বলে দেয় সেটা শেখাতে হবে।

৩. যে ব্যক্তি শিশুদের ব্যক্তিগত জায়গায় স্পর্শ করবে বা শিশুকে দিয়ে তাদের শরীরে এমনভাবে স্পর্শ করার কথা বলবে যেটা শিশুর পছন্দ হবে না, সেক্ষেত্রে শিশুদের বাধা দেওয়া শেখাতে হবে।

৪. সব বয়সী শিশুর প্রতি নজর রাখতে হবে। শিশু এমন কোনো অভিযোগ করলে সেটা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে।

৫. গুড টাচ-ব্যাড টাচ বা ভালো স্পর্শ, মন্দ স্পর্শ ধারণার সঙ্গে শিশুকে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে।

৬. বাচ্চাদের মন খুলে কথা বলা শেখাতে হবে যেন সমস্যার বিষয়ে বলতে তারা ভয় না পায়।

৭. যদি তেমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় সেক্ষেত্রে শিশুকে আশ্বস্ত করতে হবে যে সে ঘটনার জন্য শিশুটি কোনোভাবে দায়ী নয় এবং নিপীড়নকারী ব্যক্তির এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য না।

৮. পরিবারের অন্য সদস্য বা পরিচিতদের নিপীড়নকারী ব্যক্তি সম্পর্কে জানাতে হবে যেন তারা নিজ সন্তানদের নিয়ে সতর্ক থাকতে পারেন।

৯. ঘটনাকে তুচ্ছ হিসেবে দেখা বা নিপীড়নকারীর পক্ষ নেয়া যাবে না। আবার এ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের দুশ্চিন্তা বা প্রতিক্রিয়া বা অতিরিক্ত প্রশ্ন করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।

ইউকে এইডের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তৈরি করা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সে বুকলেটের সম্পাদনা করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

নিশাত সুলতানা বলছেন, প্রথম থেকেই সন্তানকে জানাতে হবে যেন এমন পরিস্থিতিতে তারা না পড়ে একদম, তারপরও যদি ধরনের ঘটনা হয়ে যায় সেটা লঘু মাত্রার হলেও সন্তানদের আগলে রাখতে হবে, চোখে চোখে রাখতে হবে।

আত্মীয় হলেও তেমন ঘটনা ঘটানো ব্যক্তিকে বাড়িতে যতটা সম্ভব আসতে না দেওয়া উচিত, শিশুকে অস্বস্তিকরভাবে স্পর্শ করা ব্যক্তিদের নিজেদের জীবন থেকে যতদূর সম্ভব ছেঁটে ফেলা অথবা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন তিনি।

শিশুদের কীভাবে বোঝাতে হবে?

সন্তানদের সুরক্ষার জন্য এ বিষয়গুলো বোঝানোটাও বাবা-মায়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আর ‘গুড টাচ ও ব্যাড টাচ’ এই ধারণা দিতে প্রায় সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা যেটা উল্লেখ করেন সেটা হচ্ছে শিশুদের ব্যক্তিগত অঙ্গ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা।

ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে ঠোঁট, গোপনাঙ্গ, পায়ুপথ; মেয়েদের ক্ষেত্রে এই তিন অংশ ছাড়াও বুকের দিকের অংশ। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফও এই অঙ্গগুলোকে একান্ত ব্যক্তিগত হিসেবে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলে।

তবে একই সঙ্গে এটাও বলা হয় যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেখানে স্পর্শ করার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন শিশুর যদি টয়লেটে বা গোসলে সাহায্যের প্রয়োজন হয় এবং ডাক্তারের কাছে স্বাস্থ্যের পরীক্ষার জন্য যেতে হয়।

এক্ষেত্রে নিরাপদ স্পর্শের উদাহরণ হিসেবে বলা হয় যদি দাদা-দাদি বা নানা-নানি কেউ জড়িয়ে ধরে এবং গালে চুমু দেয় বা বন্ধুরা হাই ফাইভ দেয়। তবে অনিরাপদ স্পর্শ হিসেবে ইউনিসেফ উল্লেখ করেছে––

১. যদি ধরলে ব্যথা লাগে

২. যদি এমন জায়গায় ধরা বা স্পর্শ করা হয় যেখানে ধরলে ভালো লাগে না বা যেখানে ধরা উচিত না (ব্যক্তিগত অঙ্গ)

৩. অস্বস্তি বোধ হয় বা খারাপ লাগে এমনভাবে কেউ ধরলে

৪. যদি এমনভাবে কেউ ধরে যাতে ভয় বা নার্ভাস লাগে

৫. যদি তাকে ধরার জন্য বা স্পর্শ করার জন্য শিশুকে জোর করে

৬. যদি স্পর্শ করে কাউকে এ বিষয়ে বলতে নিষেধ করে, চুপ থাকতে বলে

৭. যদি স্পর্শের কথা কাউকে বললে তার ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়

৮. অস্বস্তি বলতে বোঝানো হচ্ছে – মন খারাপ, রাগ, ভয়, লজ্জা কেউ এমন করলে যাকে বিশ্বাস করা যায় বা আস্থা রাখা যায় এমন মানুষকে বলতে হবে।

নিশাত সুলতানা বলছেন, শরীরের সেসব ব্যক্তিগত জায়গাগুলোতে যদি কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ করে তাহলে আমরা না বলবো, চিৎকার করবো এবং আমাদের মা-বাবাকে জানাবো বিষয়টা। যদি এরকম পরিস্থিতি হয় যে আমাদের বিপদ মনে হচ্ছে তাহলে সাথে সাথে দৌড়ে আমাদের ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

তিনি বলছেন, কেউ যদি আমাদেরকে এমনভাবে স্পর্শ করে যেটা আমাদের খারাপ লাগছে তখন আমরা চুপ করে থাকবো না, আমরা কথা বলবো, আমরা জোরে না বলবো।

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডা. ইশরাত শারমিন রহমানও বিবিসি বাংলাকে এই অঙ্গের ক্ষেত্রে বলেছিলেন এখানে বাবা মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কী করবে সেটিও তাকে জানানো। সেটা বাবা মাকে যে জানাবে সেটি শেখাতে হবে। এতে বাচ্চারা সচেতন থাকবে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আরেকটি বুকলেটে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতিবাদ করার বিষয়ে এবং মা-বাবাকে এবিষয়ে বলার ক্ষেত্রে যেন কোনো সংকোচ না থাকে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম