বাত, ব্যথা ও প্যারালাইসিসের চিকিৎসায় আকুপাংচার
ডা. এস, এম, শহীদুল ইসলাম, পিএইচডি
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৫ পিএম
আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ ডা. এসএম শহীদুল ইসলাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আকুপাংচারের মাধ্যমে যে ১০১টি রোগের চিকিৎসার সুপারিশ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বাত, ব্যথা ও প্যারালাইসিসের চিকিৎসা।
এ ছাড়া হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) আকুপাংচারের প্রমাণভিত্তিক সুপারিশ করে।
আকুপাংচার সারা বিশ্বে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্যতা পেলেও আমাদের দেশে অনেকের কাছে আকুপাংচার নতুন শব্দ বা নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে পরিগণিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ বাত-ব্যথাকে একই ভাবেন বা সংজ্ঞায়িত করেন। বাত-ব্যথা বহুল প্রচলিত শব্দ হলেও বাত হলো প্রগ্রেসিভ রোগ, শরীরে প্রবাহমান থাকে। অন্যদিকে ব্যথা রোগের উপসর্গ মাত্র। শরীরে নানা কারণে ব্যথা অনুভব হতে পারে। প্রথমে বাত শরীরের গিরাগুলোকে আক্রমণ করে নষ্ট করে ফেলে, ফলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। পরে ক্রমান্বয়ে গিরা বাঁকা হওয়া বা গিরাগুলো নড়াচড়া করতে না পারায় রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। বাত রোগ শুধু গিরার ক্ষতি করে না, অন্য অঙ্গগুলোকেও আক্রান্ত করে।
প্রথমেই বলেছি, ব্যথা রোগের উপসর্গ মাত্র। শরীরের বিভিন্ন হাড়, জয়েন্টে ব্যথা বা বিভিন্ন অংশ তথা মাথা, হাত, ঘাড়, কোমর, হাঁটু, কনুই, কব্জি, শিরা, মাংসপেশি ইত্যাদিতে ব্যথা পরিলক্ষিত হয়। দেশের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ ব্যথা রোগে ভোগেন বলে অনেকেই ব্যথা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন।
আকুপাংচার চিকিৎসাব্যবস্থা
ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম হলো একটি চিকিৎসাব্যবস্থা, যা প্রাচীন চীনা দর্শন ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ নিয়ে তৈরি হয়েছে। আকুপাংচার ট্র্যাডিশন চাইনিজ মেডিসিনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে অনেক রোগ এবং চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে আকুপাংচার স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃত ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এর অবদান অনস্বীকার্য। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আকুপাংচার চিকিৎসার উৎপত্তির ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চীনের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, আনুমানিক ৫ হাজার বছর পুরোনো চীনা এই চিকিৎসা পদ্ধতি। সময়ের পরিবর্তন ও আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে আকুপাংচার চিকিৎসারও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ফলে সেবা গ্রহীতাদের কাছে তা দিনদিন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
আকুপাংচার সম্পর্কে অনুসন্ধান করলে জানা যায়, শরীরের নির্ধারিত আকু পয়েন্টগুলোয় রোগের প্রকারভেদ অনুযায়ী অভিজ্ঞ আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ আকুপাংচার সুঁচ প্রবেশ করিয়ে এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটান এবং এর সঙ্গে বিভিন্ন আকুপাংচার সমন্বিত থেরাপি যোগ করে আকুপাংচার চিকিৎসা প্রদান করেন। লক্ষণীয় যে, আধুনিক আকুপাংচারের ক্ষেত্রে আকুপয়েন্টে সূক্ষ্ম সুঁচ প্রবেশ করিয়ে কিউই শক্তির প্রবাহ পরিবর্তন করা হয়। আকুপাংচারের সাধারণ তত্ত্বটি এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, শরীরজুড়ে শক্তি প্রবাহের বা কিউই নির্দেশন রয়েছে, যা সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই প্রবাহের ব্যাঘাত ঘটলে প্রভৃতি রোগ তৈরি হয়। আকুপাংচার চিকিৎসা কিউই বা উজ্জীবনী শক্তিতে পুনরায় ফিরিয়ে এনে রোগীকে সুস্থ করে তোলে।
আকুপাংচার চিকিৎসার প্রয়োগ
প্রচলিত ওষুধ নির্ভর চিকিৎসায় যারা সুস্থ হয়েছেন, তারা ছাড়া সেবা নিতে আসা অনেক রোগীর অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, বাতের চিকিৎসার জন্য প্রাথমিক অবস্থায় ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করেছেন। পাশাপাশি ডিজিজ মডিফাইং অ্যান্টিরিউমেটিক ড্রাগ নিয়েছেন বা অনেকেই স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকে এসব ওষুধে ভালো ফলাফল না পেয়ে বাতের আধুনিক ওষুধ বায়োলজিকালি মেডিসিন গ্রহণ করেও সুস্থ হননি।
এর কারণ হলো, শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা কখনো কখনো আমাদের বিরুদ্ধেই কাজ করে। তাই ওষুধ নির্ভরতার বাইরে বাতের চিকিৎসায় আকুপাংচার খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। বাতের চিকিৎসা প্রটোকলে আকুপাংচার, বাত রোগের ধরন বা প্রকারভেদ অনুযায়ী আকুপাংচার চায়নিজ থেরাপির পাশাপাশি লাইফস্টাইল মডিফিকেশনকে সংযুক্ত করা হয়। এতে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছেন।
আকুপাংচার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় নিজেদের সুখকর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন ধরনের ব্যথা নিয়ে যে আলোচনা করেছি, সেসব ব্যাথার উৎপত্তি ও প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে আকুপাংচার চিকিৎসা দেওয়া হয়। সাধারণত বাতের মতোই ওষুধ ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের ব্যথার রোগীকে আকুপাংচার চিকিৎসা দেওয়া হয়। আকুপাংচার, চায়নিজ মেডিসিন থেরাপিসহ ইমিউনিটি সিস্টেম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সংযুক্ত থাকে। সাধারণ মনে প্রশ্ন থাকে আকুপাংচার কোথায় করা হয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কারও কোমরে ব্যথা হলে কোমরে, হাঁটুতে ব্যথা হলে হাঁটুতে।
প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে ওষুধ ঝুঁকিমুক্ত করলেও শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে পারে না। প্যারালাইসিস পরবর্তী সমস্যাগুলো দূর করে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য আকুপাংচার ও চাইনিজ ফিজিওথেরাপি কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।
আকুপাংচার চিকিৎসা পদ্ধতি
এ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সেশন ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় ১৫টি বা ৩০টি সেশন বা প্রয়োজন সাপেক্ষে কমবেশি হয়ে থাকে।
লেখক: পাইওনিয়ার আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ ও চিফ কনসালটেন্ট, শশী হাসপাতাল