ডেঙ্গুর প্রভাব, প্রয়োজন সচেতনতা
গাজী মুনছুর আজিজ
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এছাড়া ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ২৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত জুলাই থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন আক্রান্ত হন। আগস্টে আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৫২১ জন। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন। চলতি মাসে এরই মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২৮৭।
আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে। গত জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ জনে। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত ৫৪ হাজার ২২৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
ডেঙ্গু থেকে সবাইকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। আর এজন্য সতর্কতার বিকল্প নেই। এছাড়া চিকিৎসকরা ডেঙ্গুর কিছু উপসর্গের কথা বলেন। এসব জানা থাকলে দ্রুত ডেঙ্গু আক্রান্তকে শনাক্ত করা সম্ভব।
ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ : সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এটি একটি ভাইরাস জ্বর। এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের একমাত্র বাহক। এ মশার কামড়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। এডিস মশা দিনের বেলায় বা সাধারণত ভোরে এবং সন্ধ্যায় কামড়ায়। এর সাধারণ লক্ষণ হলো জ্বর (শরীরে তাপমাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি পায়), মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেটে ব্যথা, মাংসপেশি ও হাড়ে ব্যথা (বিশেষত : মেরুদণ্ডে ব্যথা) বমি-বমি ভাব, শরীরে হামের মতো দানা দেখা দেওয়া।
দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া : তিন-চার দিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছেন, কিন্তু সেটি ভালো হচ্ছে না। এমন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। বর্তমানে ডেঙ্গুর নতুন যেসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে এটি বেশ উল্লেখযোগ্য।
জ্বর না থাকা ও বমি : হাসপাতালে এমন সব ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন, যারা এ মৌসুমে জ্বরে আক্রান্তই হননি। অর্থাৎ জ্বর না হলেও পরীক্ষার পর তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গরমের কারণে অনেকে হয়তো দুয়েক দিন হালকা জ্বরে ভুগেছেন, কিন্তু সেটি পাত্তা দেননি। কিন্তু পরে সেটি মারাত্মক ডেঙ্গুতে পরিণত হয়েছে।
প্রচণ্ড মস্তিষ্কে প্রদাহ : প্রচণ্ড মস্তিষ্কে প্রদাহ অনেকটা মেনিনজাইটিসের সমস্যার মতোই। এতে প্রচণ্ড মাথাব্যথা দেখা দেয়। অল্প জ্বরের পর কারও যদি মাথাব্যথা থাকে, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, হাত-পা শক্ত হয়ে যায় কিংবা খিঁচুনি দেখা দেয় ও হাত-পা ফুলে যায়, তাহলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা উচিত।
বুকে এবং পেটে পানি জমা ও ব্যথা : শরীরের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে বুকে এবং পেটে যদি পানি জমে যায়, তাহলে দেরি না করে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অসহ্য রকমের পেট ব্যথাও ডেঙ্গুর কারণ হতে পারে।
যে কারণে প্রাদুর্ভাব : বর্তমানে ডেঙ্গুতে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে; এর কারণ ডেঙ্গুর নতুন নতুন যে উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, এগুলোর সঙ্গে মানুষ খুব একটা পরিচিত নয়। ফলে অনেকেই বুঝতে পারেন না তার ডেঙ্গু হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছাচ্ছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ হলো দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়া।
ডেঙ্গু হলে বাড়িতে যা করবেন : মেডিসিন ও হৃদরোগের চিকিৎসক (এমবিবিএস, সিএমসি) এবং চাঁদপুর ম্যাটস লেকচারার ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া বলেন, সাধারণত ডেঙ্গুজ্বর সাত দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। তবে রোগীকে উপসর্গ অনুসারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে এবং বিশ্রামে রাখতে হবে। প্রচুর পানি ও তরল খাবার খাওয়াতে হবে। এছাড়া দ্রুত জ্বর কমানো জরুরি। এজন্য মাথা ধোয়া, ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছা এবং প্যারাসিটামল খেতে দেওয়া যেতে পারে। অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ কোনোভাবেই খেতে দেওয়া যাবে না। এছাড়া মারাত্মক (হেমোরেজিক) ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে রোগীকে অবিলম্বে হাসপাতালে/ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
ডেঙ্গু হলে বাড়িতে কিছু করণীয় কাজ রয়েছে। যেমন-পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস, খাবার স্যালাইন। ডেঙ্গুজ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারবেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
যা করা যাবে না : ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে প্লেটলেট এখন আর মূল বিষয় নয়। প্লেটলেট হিসাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। প্লেটলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে প্লেটলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। অনেকে বলেন, পেঁপে পাতার জুস ইত্যাদি খেলে প্লেটলেট বাড়ে। আসলে এসবের কোনো ভূমিকা নেই। জ্বর কমে গেলে এমনিতেই প্লেটলেট বাড়তে শুরু করে। জ্বরের শেষের দিকে রক্তচাপ কমে যেতে পারে অথবা মাড়ি, নাক, মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের দেওয়া অনুযায়ী জনসাধারণের করণীয় :
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
এজন্য বাড়ির ভেতর/বাইর/ছাদ এবং আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় পাত্রগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিন। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় এবং আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখুন।
ব্যবহার যোগ্য পাত্রগুলো যেমন : বালতি, ড্রাম, ফুলের ও গাছের টব, ফ্রিজ এবং এয়ার কন্ডিশনারের নিচের পানিভর্তি পাত্র ইত্যাদি কোনোভাবেই যেন একনাগাড়ে পাঁচ দিনের বেশি পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখুন এবং প্রয়োজনে সরিয়ে ফেলুন।
অব্যবহৃত গাড়ির টায়ার, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের বোতল/ক্যান, গাছের কোটর, পরিত্যক্ত হাঁড়ি, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে পাঁচ দিনের বেশি যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখুন এবং প্রয়োজনে সরিয়ে ফেলুন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করণীয় : ডেঙ্গু রোধে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ কিছু সচেতনতামূলক কাজ করা জরুরি। যেমন-খেলার মাঠ ও ভবনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
মাঠ বা ভবনে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যেসব ফুলের টব রাখা হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। এডিস মশার প্রজননস্থলে যাতে পানি জমতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় নিয়ে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন।