মা-মেয়ের অপমৃত্যু মামলার তদন্তে মিলল লোমহর্ষক তথ্য
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৯ পিএম
পুলিশের হাতে গ্রেফতার বিধান দাস। ছবি: সংগৃহীত
গত ৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ বক্সের ডিউটি অফিসার কোতোয়ালী থানায় ফোন করে জানান- রাজধানীর সদরঘাট থেকে সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি অচেতন অবস্থায় এক নারী ও তার শিশু সন্তানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে চলে গেছেন।কর্তব্যরত চিকিৎসক অজ্ঞাতনামা নারীকে মৃত ঘোষণা করে এবং শিশু সন্তানটিকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করে।
খবর পেয়ে কোতোয়ালী থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায় এবং ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ওই নারীর পরিচয় শনাক্ত করে। ওই নারীর স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাটে যোগাযোগ করা হলে তার ভাই হাসপাতালে এসে মরদেহ শনাক্ত করেন।
জানা যায়, তার নাম মাধুরী বিশ্বাস (৩৬) ও চিকিৎসাধীন তার কন্যা শিশুর নাম শ্রেষ্ঠা (৭)। সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে লাশ ভিকটিমের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং চিকিৎসাধীন শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ওই ঘটনায় ৬ ডিসেম্বর ভিকটিমের বড় ভাই নারায়ন বিশ্বাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজধানীর কোতোয়ালী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়।
অপমৃত্যু মামলা হওয়ার পর থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে।এরপরই বেরিয়ে এলো লোমহর্ষক তথ্য।
পুলিশ জানতে পারে আট বছর পূর্বে খুলনা জেলার তেরখাদা থানার পিংকু মজুমদারের সঙ্গে মাধুরী বিশ্বাস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের সাত বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। মেয়ে শ্রেষ্ঠাসহ মাধুরী বিশ্বাস গত ২৮ নভেম্বর সকালে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বাগেরহাটের উদ্দেশে রওনা হন। এরপর মাধুরী ও তার শিশু কন্যার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
এদিকে তদন্তে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ বিধান দাস নামের একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির সন্ধান পায়। এরই প্রেক্ষিতে পুলিশ বিধান দাসকে গতকাল (১৭ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার থ্রী এ্যাঙ্গেল ডক এলাকা থেকে আটক করে। এ সময় তার হেফাজত থেকে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিধান দাস পুলিশকে জানান, তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা এলাকায়। তিনি একটি বাল্কহেডের ইঞ্জিন শ্রমিক। ঘটনার ৪-৫ মাস আগে তার জাহাজের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে তিনি মাধুরীর মোবাইল নম্বর পান এবং তাকে কল করেন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে এবং সম্পর্ক পরকীয়ায় রূপ নেয়।একপর্যায়ে মাধুরী বিধানকে বিয়ের জন্য চাপ দেন, কিন্তু বিধান রাজি হন না। বিধান জানান, তিনি ছুটিতে বরিশাল যাবেন। তখন মাধুরীও বরিশাল যাবেন বলে জানান। ২৮ নভেম্বর মাধুরী বাবার বাড়ি বাগেরহাট যাওয়ার জন্য মেয়ে শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে বের হয়ে খুলনা থেকে বাসযোগে বরিশাল যান এবং একইদিন বিধান ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেন। ওই দিন বিকাল ৩টায় বরিশালের নতুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে তাদের দেখা হয় এবং স্থানীয় এক আবাসিক হোটেলে কক্ষ ভাড়া করে অবস্থান করেন তারা। ২৯ নভেম্বর বিধান মাধুরীকে হোটেলে রেখে পটুয়াখালী যান। ইতোমধ্যে বিধান তার পারিবারিক কাজ নিয়ে ব্যস্ততার কথা বলে পটুয়াখালী অবস্থান করেন এবং মাধুরীকে জানান তিনি যেন পটুয়াখালী চলে আসেন। সেখান থেকে তারা একসঙ্গে ঢাকা যাবেন।
এদিকে বিধান পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন কিভাবে মাধুরীকে তার জীবন থেকে সরানো যায়। ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা দশমিনা বাজারের নলখোলা বন্দরের একটি দোকান থেকে ঘাস মারার কীটনাশক ওষুধ ক্রয় করেন বিধান। ৪ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টায় বিধান, মাধুরী ও তার শিশু কন্যা শ্রেষ্ঠাসহ কালাইয়া লঞ্চঘাটে আসেন এবং বিধান লঞ্চের একটি কেবিন ভাড়া করেন। কেবিনে উঠার কিছু সময় পর মাধুরী শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে বাথরুমে গেলে বিধান পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তার পকেটে থাকা বিষ একটি পানির বোতলে ভরে কেবিনের বক্সে রেখে দেন। লঞ্চ ছাড়ার পর খাওয়া দাওয়া শেষে শ্রেষ্ঠা ঘুমিয়ে পড়লে বিধান ও মাধুরীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয় এবং বিধান মাধুরীকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বলে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক বিষ মেশানো পানি পান করতে দেন।
ওই সময় মাধুরী জানান শ্রেষ্ঠারও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তাই ওকেও ঘুম থেকে ডেকে বিষ মেশানো পানি খাওয়ান বিধান। ওষুধ খাওয়ার পর দুজনই দুইবার বমি করে। এতে মাধুরী ও শ্রেষ্ঠা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। পরদিন (৫ ডিসেম্বর) সকাল আনুমানিক ৫টার দিকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছানোর পর বিধান মাধুরী ও শ্রেষ্ঠাকে টার্মিনালের এক জায়গায় বসিয়ে খাবার আনার কথা বলে যাত্রবাড়ী তার জাহাজে চলে যান।
পরবর্তীতে সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৪নং গেটের সামনে মা ও মেয়েকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিকিৎসার জন্য সকাল ৯টা ১০ মিনিটের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মাধুরীকে মৃত ঘোষণা করেন এবং তার শিশু কন্যা শ্রেষ্ঠাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। চিকিৎসার সুবিধার্তে শ্রেষ্ঠাকে তার আত্মীয়স্বজন গোপালগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে সে ১৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করে।
এদিকে বিধান দাসকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে আদালতে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ঘটনার দায় স্বীকার করে তিনি নিজেকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।