Logo
Logo
×

যুগান্তর বর্ষপূর্তি

২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান: বারুদগন্ধী সময়ের আর্তস্বর

Icon

অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৯ এএম

২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান: বারুদগন্ধী সময়ের আর্তস্বর

অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা। ছবি: সংগৃহীত

আর্জেন্টিনার মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারা বলেছিলেন, ‘যখনই তুমি কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠো, তখনই তুমি আমার একজন সহযোদ্ধা।’ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও অধিককাল নিপীড়িত হতে হতে বাংলাদেশের আমজনতা একসঙ্গে জ্বলে উঠেছিল, গত বছরের লাল জুলাই মাসে। অকুতোভয় ছাত্র-জনতা শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স-সব ভেদাভেদ মুছে দিয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতির সম্মিলিত প্রতিরোধ নাড়িয়ে দিয়েছিল স্বৈরশাসকের ভিত্তিমূল। 

২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল ১ জুলাই থেকে, কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে। ছাত্র-সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি যৌক্তিক ও ন্যায্য আন্দোলনকে সহিংস করে তোলা হয় ১৫ জুলাই থেকে। 

১ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা বললেন, কোটা বিষয়ে তার কিছু করার নেই, সেই সঙ্গে আরও বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’ তার এ বক্তব্য চারদিকে দাবানলের পরিস্থিতি তৈরি করে দিল। 

তৎকালীন স্বৈরশাসক যে কোনো ন্যায্য দাবিকে স্বাধীনতাবিরোধী বিশেষ-কিছু শব্দ দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে, গত ১৫-১৬ বছর কিন্তু এবার কোনো অজুহাত আর কাজে লাগেনি। সেদিন শিক্ষার্থীরা দমে না গিয়ে বরং অনেক বেশি শক্তি ও সংক্ষোভে এ ‘রাজাকার’ শব্দটিকে ব্যাজস্তুতির মতো ব্যবহার করে তাদের আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। অর্থাৎ আর কোনো অজুহাতে বা

বিশেষ কোন ট্যাগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের দমন করা যাবে না, এটি তারা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শুরু করল। 

‘রাজাকার স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে’, ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন উসকানিমূলক বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী অন্যান্য নেতার উসকানিমূলক বক্তব্যে আন্দোলন আরও ঘনীভূত হতে থাকে। সেদিনই অর্থাৎ ১৫ জুলাই বিকাল থেকে জাহাঙ্গীরনগরের বিভিন্ন স্পটে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতে থাকলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তৎকালীন উপাচার্য মহোদয়ের বাসায় আশ্রয় নেয় কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি।

উপাচার্য ভবনে প্রশাসনিক বডির উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী, তাদের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী (যাদের আমরা বিভিন্ন ভিডিওতে দেখেছি), পুলিশ বাহিনী একযোগে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, তাতে অনেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক আহত হন। ১৬ জুলাই থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৬ জুলাই সকালেই আমরা প্রায় ১০০ জনের মতো শিক্ষক মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রশাসন ভবনে উপস্থিত হই এবং এ নির্মম নির্যাতনের বিচার চাই। প্রশাসন দায়সারা গোছের গতানুগতিক উত্তর দিয়ে পার পেতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা তা মানিনি। 

এরই মধ্যে প্রশাসন তড়িঘড়ি ও জবরদস্তি করে হল ভেকেন্ট করে দেয়। আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষক সারা দিন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করি এবং বিচার চেয়ে বক্তৃতা দিই। হল ভেকেন্ট হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের আশপাশে গেরুয়া, আমবাগান, ইসলামনগর, পানধোয়া প্রভৃতি গ্রামে অবস্থান করছিল। ১৭ জুলাই শিক্ষার্থী এবং আমরা আবারও প্রশাসন ভবনে যাই, ৭-৮ জন শিক্ষক উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই কিন্তু আমাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীরাও ক্রমে ক্রমে প্রশাসন ভবনের সামনে জমা হয়, প্রশাসন থেকে নানা হুমকি দেওয়া হতে থাকে। একপর্যায়ে বলা হয় ৪টার মধ্যে শিক্ষার্থীরা সরে না গেলে আক্রমণ করা হবে-কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে উপাচার্যের ভবনকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই নিরাপদ আশ্রয়ে সরকারের পেটোয়া বাহিনী, ভাড়াটে সন্ত্রাসী, পুলিশ বাহিনী রাতের আঁধারে কেন নির্বিচারে এ নির্যাতন-অত্যাচার করল এ জবাব না নিয়ে যাবে না, তারা প্রশাসনের সঙ্গে দেখা করতে চায় কিন্তু প্রশাসন দেখা করেনি, বরং ৪টার দিকে পুলিশ বাহিনী দিয়ে আবার শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। 

 এদিকে ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের আত্মবিশ্বাসী বুকটাকে যখন পুলিশ বুলেটে বুলেটে ঝাঁজরা করে দেয়, তখন সেই ব্যথা আমাদের প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, ১৭ তারিখ আবার কী হবে, সেই আতঙ্কে আমি আর বাসায় যেতে পারিনি। আমি পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল দেখেছি, বন্দুকের গুলির শব্দ শুনেছি, দেখেছি শিক্ষার্থীদের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার বিভাগে চলে আসার কথা বলি। আমি কাউকে না জানিয়ে আমার অফিস কক্ষ, সেমিনার কক্ষ খোলা রেখেছি, শিক্ষার্থীরা দৌড়ে এসে যেন অন্তত আমার বিভাগে আশ্রয় নিতে পারে, যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে বিভাগের ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ড পাঠিয়েছি যে কোনো প্রয়োজনে যেন যোগাযোগ করতে পারে। আর আমি সমাজবিজ্ঞান-টারজান পয়েন্টের রাস্তায় থেকে যাদের কাছে পেয়েছি তাদেরকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। 

যেসব নারী শিক্ষার্থী ছোটাছুটি করতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল তাদের উদ্ধার করে হলে দিয়ে আসার চেষ্টা করি এবং হলের গার্ডদের অনুরোধ করি শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নিতে এলে তাদের যেন ফিরিয়ে দেওয়া না হয়। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের উদ্দেশ করে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই। সন্ধ্যার পর দৌড়ে ক্যাম্পাসের মেডিক্যাল সেন্টারে যাই এবং আহত শিক্ষার্থীদের করুণভাবে কাতরাতে দেখি, আমরা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি এবং আহত শিক্ষার্থীদের যেন দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় তার অনুরোধ করি। ওই দিনই অর্থাৎ ১৭ জুলাই রাত সাড়ে সাতটায় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন-ছাত্র-জনতা আশা করেছিল হয়তো তিনি আশাজাগানিয়া কোনো বক্তব্য দেবেন, কিন্তু জাতি তার বক্তব্য শুনে প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়েছে। 

জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের চারপাশে আশ্রয় গ্রহণ করলে সরকারের পেটোয়া বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী নানাভাবে হয়রানি, ধরপাকড় করতে থাকে। আমরা কয়েকজন শিক্ষক একসঙ্গে মিলে কীভাবে তাদের ছাড়িয়ে আনা যায় সেই চিন্তা করি, কখনো আবার গ্রামবাসীকে অনুরোধ করি, শিক্ষার্থীদের যেন একটু নিরাপদ আশ্রয় দেয়। ১৮ তারিখ সারা দেশে সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন শিক্ষক শহিদ মিনারে জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়াই। 

ইতোমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে রূপ নেয়। তারপর দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’, সারা দেশে অভিযান, গ্রেফতার, হত্যা, নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়ে হত্যা-জুলুম এসব চলতে থাকে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে যায়, ধরে নিয়ে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকেও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমরা তাদের মুক্তি দাবি করি এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করি। ৩০ জুলাই শহিদদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকের প্রোফাইল আমরা লাল করি এবং ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। 

নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যখন সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহারের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি এটি একটি সাজানো নাটক। তখন আমরা মাত্র ৪ জন শিক্ষক এবং ক্যাম্পাসের চারপাশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা মিলে সেদিনই একটি মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আসে। ধীরে ধীরে আমরা এক নতুন ইতিহাস গড়ার দিকে এগোতে থাকি। ১ আগস্ট ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হলেও সারা দেশে তখনো স্বৈরাচার সরকার হত্যা-জলুম-গ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছে। 

১ আগস্ট হত্যা-জুলুমের বিরুদ্ধে শহিদ মিনারের পাদদেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশন শেষে আমরা দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে একটি র্যালি নিয়ে বের হই। সারা দেশের শহিদের উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত শহিদ স্মৃতিস্তম্ভের কাছে গিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করি। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে গিয়ে আমি যেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, ফরহাদ হোসেন, জাহিদুজ্জামান তানভীন, ওয়াসিম, তাহমিদ, ইরফান, শাকিল, পারভেজ, জিল্লুর, দীপ্ত দে, রুদ্র সেন প্রমুখ ছাড়াও নাম মনে করতে পারছি না এমন অনেক শহিদের নাম মাথায় ঘুরছিল, সেই সঙ্গে প্রতিদিনই সন্তান হারানো মায়ের আহাজারি, নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর প্রতিনিয়ত স্বৈরশাসকদের অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল-আমার এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে সারা দেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হয় এবং অন্যদিকে স্বৈরশাসকের গদিতেও টান পড়ে। এ চিন্তা করে বিভাগের অফিসে এসে শেখ হাসিনার ছবিটা দেখেই মনে হয়েছে 

এই ছবি এখানে আর মানানসই না। যার হাতে এতো রক্তের দাগ, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে এতটা রক্তাক্ত করেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন, তার আর এ দেওয়ালে থাকার অধিকার নেই। আমি ছবিটি নামিয়ে ফেলি। তারপর তো ইতিহাস। বিভাগ থেকে বাসায় আসতে আসতে এ ঘটনাটি হাজার হাজার শেয়ার হয়ে যায়। এ সময় আমার সন্তান, শিক্ষার্থীরা আমাকে যেমন অভিবাদন জানিয়েছে, তেমনি স্বৈরাচারের দোসররা আমাকে নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’ থেকে আমার শাস্তি চেয়ে লিফলেট বিতরণ করে। জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে আমাকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সাংবাদিক এবং পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, যদিও শোকজ লেটার আমি পাইনি। এরপরও আমি আন্দোলন থেকে পিছপা হইনি, ২ তারিখ গণমিছিল, প্রার্থনা, ৩ তারিখ আন্দোলন এক নতুন মোড় নেয়-সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ৪ আগস্ট সারা দেশে অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে ব্যাপক সংঘাত এবং প্রায় ১৫০ জনের মতো মৃতু্যুর কারণে ৬ আগস্টের লং মার্চকে ৫ আগস্ট এগিয়ে আনা হয়। 

৫ তারিখ সারা রাত ঘুমাতে পারিনি, দোয়া পড়েছি-বড় কোনো হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞ যেন না ঘটে। শুনতে পাচ্ছি দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এসে জমায়েত হচ্ছে ঢাকার দিকে। ৫ আগস্ট সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সকাল ১০টার দিকে কারফিউ অবজ্ঞা করে আমরা ঢাকার দিকে লং মার্চে রওয়ানা দেই, ৭-৮ জন শিক্ষকের সঙ্গে আমি একমাত্র নারী-শিক্ষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ আশপাশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং একসময় আশপাশের শ্রমিকরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগদান করেন। 

আমরা অল্প অল্প করে এগোতে থাকি কারণ সামনেই পুলিশের ব্যারিকেড। ধীরে ধীরে যেতে যেতে আমরা সাভার সিটি সেন্টারের কাছে পৌঁছে যাই কিন্তু সেখানে অনেক পুলিশ থাকায় তারা বাধা সৃষ্টি করে, আমরা থেমে যাই। সমন্বয়ক এবং শিক্ষকরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, আমি মিছিলের তত্ত্বাবধানে থাকব আর ৭ জন শিক্ষক পুলিশের কাছে গিয়ে আমরা যেন ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে পারি সে বিষয়ে অনুমতি নিয়ে আসবে। কিন্তু বিধিবাম! শিক্ষকরা হাত উঁচু করে পুলিশের দিকে অগ্রসর হন আর সমন্বয়করা পুলিশের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে-উনারা আমাদের শিক্ষক, আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। 

শিক্ষকরা যখন পুলিশের কাছাকাছি, তখন তারা কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে শিক্ষকদের দিকে কাঁদানো গ্যাস ছুড়তে থাকে এবং আমাদের দিকেও কাঁদানো গ্যাস ছুড়তে থাকে। আমাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, সিটি সেন্টারের ওপর থেকে কারা যেন গুলি ছুড়তে থাকে। কাঁদানো গ্যাসের ফলে আমি চোখে কিছু দেখতে পারছিলাম না, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, ছোটাছুটি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে পড়ে গিয়ে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পাই। এমন সময় দেখতে পেলাম আমি একা হয়ে গিয়েছি। সিটি সেন্টারের সামনে, আমার পাশ দিয়ে গুলি ছুড়ছে। আমি ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এরই মধ্যে আমার দুজন শিক্ষার্থী এসে মুখে পেস্ট দিয়ে দিল, টিসু পেপারের আগুন ধরিয়ে মুখের কাছে নিয়ে এলো। আমি ভীষণ কষ্টে রোড ডিভাইডার পার হই। রাজ্জাক প্লাজার পাশে আমার একজন সহকর্মীর দেখা পেয়ে আশ্বস্ত হই। 

অন্যান্য সহকর্মী যারা ছিলেন, তারাও আমার খোঁজ নিতে থাকেন। টিয়ার গ্যাসের শেল ও গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। এরই মধ্যে আমার একজন ছাত্র সিএনজি ঠিক করে দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের একজন শিক্ষক দ্রুত আমার কাছে এসে বলেন, ‘ওড়না দিয়ে দ্রুত মাথা-মুখ ঢাকেন।’ এরপর তারাই আমাকে সিএনজি দিয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। স্বৈরাচারী হাসিনা যখন পদত্যাগ করেছেন তখনো সাভার এলাকায় স্বৈরাচার বাহিনী হত্যা অব্যাহত রেখেছে। সেদিন সাভারে শ্রাবণ, আলিফ, সাফুয়ানসহ অসংখ্য নাম না জানা মানুষকে হত্যা করা হয়। 

৫ তারিখের পর ভ্যানে করে পোড়ানো কতশত লাশ আমরা দেখেছি নানা গণমাধ্যমে। কী বীভৎস! কী নির্মম! আমি জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সব শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি, আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। সেইসঙ্গে নিহত আহতদের তালিকা এবং তাদের প্রতি সরকার যেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করি। বৈষম্য দূর করার যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের স্বপ্ন সারথিরা রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ হোক। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অভাবিতপূর্ব। তাই সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন জরুরি। নারী তার শক্তি ও সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। নারীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি আন্দোলনে গতিসঞ্চার ও সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ভূমিকা রেখেছিল। নারীর ন্যায্য অধিকার ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। 

আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় মানুষ ছিল মৌলিক মানবাধিকার ও ভোটাধিকার বঞ্চিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা দরকার। মানুষ যেন নির্ভয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারে। প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। গুণগত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষা কমিশন গঠন এবং শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ। 

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম