Logo
Logo
×

যুগান্তর বর্ষপূর্তি

অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরে

Icon

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৩ এএম

অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরে

৫ আগস্ট দুপুরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ফোন করলেন। বললেন, সেনাপ্রধান ক্যান্টনমেন্টে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক বৈঠক ডেকেছেন। আমি জানতে চাইলাম, কে যোগাযোগ করেছে। সাইফুল হক বললেন, তাকে কেউ ফোন করেনি। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি তাকে এ খবর দিয়েছেন। 

কেন জানি খবরটার ওপর আমি খুব আস্থা রাখতে পারলাম না। অতএব আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সরাসরি কেউ আমাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এ অবস্থায় যাবেন কি যাবেন না?

তখনকার মতো যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখলাম। কিছুক্ষণ পর সাইফুল হক আবার ফোন করলেন। সাকি তো যাচ্ছে। ও গেলে তো গণতন্ত্রের মঞ্চের যাওয়া হয়ে গেল। কী করবেন? আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, ঠিক আছে, চলেন যাই। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

সবকিছু কেমন ভোজবাজির মতো দ্রুত ঘটে গেল। আজ সকালেও এসবকিছুই অসম্ভব ছিল। বন্ধু আবদুল্লাহ ফোন করেছিল, কিছু হবে রে? ছাত্ররা তো জানবাজি রেখে লড়ছে। আমি কী বলব? যখন ছাত্র ছিলাম, আজকের এ শিক্ষার্থীদের মতো তরুণ ছিলাম, তখন স্লোগান দিতাম, ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।’ সে লড়াই আমরা জিততে পারিনি। এখন কি জিততে পারব?

কিন্তু আমি রাজনীতি করি। অসহায়, জীবনযুদ্ধে পরাজিত লোকদের বুকে আশা জাগিয়ে তোলাই আমার কাজ। আমি আবদুল্লাহর প্রশ্নের জবাবে বললাম, নিশ্চয়ই জিতব। অপেক্ষা করতে থাক।

রাস্তায় নেমে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। গুলশানের এ গলিতেও হাজার হাজার লোক তখন। সবার মনে উচ্ছ্বাস, বিজয়ের আনন্দ, চোখে প্রত্যয়। কত লোক এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল, কোলাকুলি করল। তাদের বিজয়ের উচ্ছ্বাসের কথা বলল। আমাকে তারা এ লড়াইয়ের এক অগ্রণী সৈনিক হিসাবে জানে। আমাকে অভিনন্দন জানাল। মানুষে মানুষে ঠাসা গুলশান ১ নম্বর চক্কর থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার সন্ধ্যা হয়ে গেল। ততক্ষণে সেনানিবাসের বৈঠক শেষ হয়ে গেছে। গেট থেকে বলা হলো, সবাই এখান থেকে বঙ্গভবনে যাবেন। সন্ধ্যার পরে সেখানে আবার আপনাদের বৈঠক হবে।

সন্ধ্যার পরে বঙ্গভবনের বৈঠকটির বর্ণনা দেওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ ওখানে বস্তুত কিছু হয়নি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যারা পতিত হয়েছেন, তাদের বাদ দিয়ে আর সবাই প্রায় ওই বৈঠকে ছিলেন। ইসলামপন্থি দলগুলোর প্রায় সবাই ছিলেন, যদিও তাদের সবাই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন না। বাড়তি ছিল জাতীয় পার্টি। পরে তো তাদের বাদ দেওয়া হলো। 

এছাড়া চারজন সমন্বয়কারী এসেছিলেন। পরে অবশ্য দেখা গেল এরা ঠিক জেনুইন সমন্বয়কারী নয়। তবে তারা আন্দোলনে ছিল। যাই হোক, বৈঠক শুরু হলো। বেশ অগোছালোভাবে। রাষ্ট্রপতি এলেন। ফর্মালিটি যেগুলো করা হয়, সেগুলো করা হলো। মিটিংটা শুরু হলো এলোমেলোভাবে। সম্ভবত আসিফ নজরুলই জানতে চাইলেন সংসদের অবস্থা কী। ওটা কি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, নাকি এখনো আছে? ওটা তো আর থাকতে পারে না। তাহলে আর নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। সবাই একমত হলেন অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে এবং সেই অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়া হলো।

জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করবেন? এখন কি আমরা সবাই মিলে বসে আলাপ-আলোচনা করে একটা সরকার গঠন করতে পারব? তার চাইতে ওরাই যা করার করুক।

আমি আগে বলেছি, ৫ আগস্ট সকালেও আমি এরকম একটা পরিবর্তনের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। এজন্য নতুন একটি সরকারের ধারণাও আমার মধ্যে ছিল না। পনেরো বছর লাগাতার যে আন্দোলন চলছে, তার অনেক উত্থান-পতন আছে, পরিবর্তন আছে। 

আলোচনার মধ্যে এ কথাও এসেছিল, এ সরকার পরিবর্তন হলে কী রকম সরকার আসবে। অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছিলেন। সাধারণভাবে সেই ধারণাই তো আমাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু আমরা যখন লড়াই করছি, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে প্রশ্ন এসেছে, শুধু সরকার বদল করলে তো কোনো লাভ হয় না। এরকম কতবারই তো হলো। তখন আমাদের জবাব ছিল, আমরা শুধু সরকার পরিবর্তনের লড়াই করছি না, আমরা একই সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের জন্যও লড়াই করছি। সেজন্য রাষ্ট্রের সংস্কার করতে হবে এবং সেই ধরনের সংস্কার কর্মসূচি আমরা তৈরি করছি (পরে যেটি ৩১ দফা হিসাবে জনসমক্ষে আমরা হাজির করেছিলাম)। 

আমরা বলেছিলাম, এ ফ্যাসিবাদী সরকার চলে গেলে তার জায়গায় একটি কেয়ারটেকার সরকার হবে না; সরকারটা হবে অন্তর্বর্তী সরকার, যা নিয়মিত সরকার হিসাবেই দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি সংস্কার কার্যও পরিচালনা করবে। বস্তুত প্রতিটি অন্তর্বর্তী সরকার সেভাবেই কাজ করে। সেই ধরনের সরকার কীভাবে গঠিত হবে? পরবর্তীকালে এ প্রশ্নগুলো আর কখনো বিশদভাবে আলোচিত হয়নি বা কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি তাই মির্জা ফখরুলের কথা সমর্থন করিনি। এখানে যারা বসে আছেন, তারা যদি একটি সরকার গঠন করে দেন, সেই সরকার কি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণপূর্বক সংস্কার করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে পারবে? এভাবে কখনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। অতএব এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা ছিল না। আমি তাই ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ ছিলাম। তারপরে যেটা হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছেন। এ সরকার গঠন নিয়ে বিতর্ক পরে আরও বেড়েছে। আমি নতুন সরকার যে শপথ নিয়েছে, সেই অনুষ্ঠানে ছিলাম। ওখানেই শুনেছি কবি, সাহিত্যিক, চিন্তক ফরহাদ মজহার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ গ্রহণ ঠিক মনে করেননি; যদিও সেই শপথগ্রহণকারীদের মধ্যে তার স্ত্রী ফরিদা সরকারও ছিলেন। সেটা অবশ্য থাকতেই পারেন। স্বামী যা বলবেন, স্ত্রীকে যে তাই মেনে চলতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।

পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সেদিনের সেই আলোচনায় সরকার গঠন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। ৫ আগস্টের তিনদিন পর সরকার গঠিত হয়েছে। এ তিনদিন নিশ্চয়ই অনেক কথাবার্তা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সবাই জানেন শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হয়েছেন। তখন বিজয়ের সব তিলক এ শিক্ষার্থীদের কপালে। এরাই তো জানবাজি লড়াইটা করেছেন এবং ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদকে গদি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন, যেটি রাজনৈতিক দলগুলো পারেনি। তারা প্রস্তাব করেছেন ড. ইউনূসের নাম। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা বাকি উপদেষ্টাদের নাম সিলেক্ট করে থাকেন। এখানেও নিশ্চয়ই তাই হয়েছে।

ঠিক কীভাবে, কী প্রক্রিয়ায় এ সরকারটি গঠিত হয়েছে, তা অবশ্য আমার জানা নেই। অতীতেও যে কবারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে, তার প্রথমে ঠিক হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নাম এবং এটি সাধারণত হয়েছে অংশীজনের মধ্যে একধরনের সমঝোতার ভিত্তিতে। প্রধান উপদেষ্টা ঠিক হয়ে গেলে বাকিগুলো, মানে অন্যান্য উপদেষ্টা ঠিক হয়ে যেতে বড় কোনো জটিলতা হয় না। আর এখানে প্রধান উপদেষ্টা ঠিক হয়েছে তো কোনো জটিলতা ছাড়াই।

ড. ইউনূস একজন নোবেলবিজয়ী। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব। কেবল বিগত সরকার, তার দল ও জোট এবং বিশেষ করে সরকারপ্রধান নিজেই ড. ইউনূসের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ওরকম কিছু নেই। সবাই ড. ইউনূসকে খুশি মনে মেনে নিয়েছে। সুতরাং, এখানে আর কোনো জটিলতা থাকার কথা নয়। কিন্তু কথা উঠেছে। জনাব ফরহাদ মজহারের একটা প্রশ্নের কথা তো আমি একটু আগে বলেছি। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনার নিয়োজিত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর কাছে কেন শপথ নেওয়া হলো। শপথটি বঙ্গভবনে না হয়ে শহিদ মিনারেও তো হতে পারত। তাহলে এটার একটা গণ বা বিপ্লবী চরিত্র থাকতে পারত।

ব্যক্তিগতভাবে আমি জুলাই-আগস্টের আন্দোলন এবং তার মাধ্যমে সরকার অপসারণকে বিপ্লব বলি না। আমার সংগঠন নাগরিক ঐক্যের মূল্যায়নও তা নয়। ক্ষমতার যখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, তখন সেখানে শ্রেণির প্রশ্ন জড়িত থাকে। আজকাল অনেকেই শ্রেণির প্রশ্ন অস্বীকার করেন। সেক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের প্রশ্ন অবশ্যই থাকবে, যেটি মৌলিক। এ দুটি শর্তের কোনোটাই ৫ আগস্ট পূরণ হয়নি। 

অতএব জুলাই-আগস্টের আন্দোলন অবশ্যই বিশ্ব আয়তনে একটি মহান গণ-অভ্যুত্থান, যার তুলনা সম্ভবত কেবল বাংলাদেশ নিজে। যেভাবে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তার উদাহরণ কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রংপুরের আবু সাঈদের সাহসী আত্মদান জুলাই-আগস্টকে এক অনন্য অভিধায় উন্নীত করেছে। সম্ভবত এ কারণে অনেকেই একে বিপ্লব বলেছেন। অনেকে যখন দেখেছেন এখনো তো চুপ্পু আছেন, সংবিধান আছে, তখন আর একবার তারুণ্যের উন্মাদনায়, বিপ্লবের বিশাল উদ্বোধনে তাড়িত হয়ে আর একটি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। বিষয়টি বিশেষ বিবেচনার দাবিদার।

এ ঘটনায় খুবই নিবিড়ভাবে জড়িত আসিফ নজরুলের বক্তব্য আমি শুনেছি। যারা বলেছেন, আমাদের আসলে তখনই বিপ্লব ঘোষণা করা উচিত ছিল, বিপ্লবী সরকার গঠন করা উচিত ছিল; আসিফ তাদের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, সেনানিবাসে যখন আমরা বসেছিলাম, তখন এরকম কথা কিন্তু কেউ বলেননি। তার মানে এই দাঁড়ায়, বিপ্লবের চিন্তা তখন বলতে গেলে কারও মাথায় ছিল না। বিপ্লবী সরকার আসবে কোত্থেকে?

কেউ কেউ জুলাই-আগস্টকে বিপ্লব হিসাবে অভিহিত করে এ বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে থাকেন। তা হতেই পারে। Long live Revolution বা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, এরকম স্লোগান তো বিশ্বের বহু দেশে চালু হয়েছিল। বাংলাদেশেও আমরা এরকম স্লোগান দিতাম। এখন যারা এরকম স্লোগান দিচ্ছেন, তারা কী ভেবে দিচ্ছেন? তারা নিশ্চয়ই কিউবা, রাশিয়া বা চীনের মতো ভেবে দিচ্ছেন না। 

একটা কথা আমাদের সবার কাছেই পরিষ্কার থাকা উচিত, ড. ইউনূস একজন বিপ্লবী নন। ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে তিনি বিপ্লব মনে করে দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। আর যদি হতেন, তাহলে নিশ্চয়ই সুপ্রিমকোর্ট থেকে রায় নিয়ে তারপর সরকার গঠনের কথা ভাবতেন না। এ কথা থেকে নিশ্চয়ই এখন সবার কাছে পরিষ্কার, ড. ইউনূস না চাইলে রাষ্ট্রপতি হিসাবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু গদিতে আসীন থাকতেন না। 

লেখক: আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম