Logo
Logo
×

যুগান্তর বর্ষপূর্তি

কেমন ছিল জুলাই বিপ্লবের ঘটনাবহুল ৩৬ দিন

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩২ এএম

কেমন ছিল জুলাই বিপ্লবের ঘটনাবহুল ৩৬ দিন

ফাইল ছবি

‘সকালে ফুলের বনে যে আলো আসে তাতে বিস্ময় নেই, কিন্তু পাকা দেওয়ালের ফাটল দিয়ে যে আলো আসে সে আরেক কথা। যক্ষপুরে তুমি সেই আচমকা আলো।’ চব্বিশের ছাত্র-জনতা রক্তকরবীর সেই আচমকা আলো হয়েই যেন ঢুকে পড়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার যক্ষপুরীতে। আর তাতেই ধসে পড়েছে হাসিনার টানা ১৫ বছর নির্মাণ করে চলা ফ্যাসিজমের পোক্ত দেওয়াল। ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’, অথবা ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘লাখো শহিদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’। 

রক্তে বান ডাকা এমন স্লোগান সঙ্গে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতার কাছে শোচনীয় পরাজয় বুঝতে পেরে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে পালিয়ে যায় দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর মসনদ দখলে রাখা কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা। কেমন ছিল ঐতিহাসিক এ আন্দোলনের ঘটনাবহুল ৩৬ দিন; সেটাই দেখতে চেয়েছি এখানে।

ঘটনার সূত্রপাত: গত ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই দিনই রায় প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা। 

এরপর ৯ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তারা। একই দাবিতে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।

১ জুলাই: কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।

২ জুলাই: আন্দোলনকারীরা এ দিন বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল করে নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে গিয়ে থামে। সেখানে তারা এক ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। একই দিন বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন।

৩ জুলাই: এই দিন আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টার মতো অবরোধ করে রাখেন। দেশের আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন।

৪ জুলাই: সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে স্থগিত হয়নি। শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ দিন ছাত্র সমাবেশ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।

৫ জুলাই: ছুটির দিন শুক্রবারও বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে সড়ক অবরোধ।

৬ জুলাই: দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের মতোই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্রধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। যার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’।

৭ জুলাই: বাংলা ব্লকেডে স্থবির রাজধানী ঢাকা। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা।

৮ জুলাই: ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবরোধ, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধ। সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাশের দাবি।

৯ জুলাই: হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থীর আবেদন। আন্দোলনের অংশ হিসাবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা চার ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।

১০ জুলাই: সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ আপিল বিভাগের।

১১ জুলাই: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। 

১২ জুলাই: কোটা সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। রেলপথ অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

১৩ জুলাই : সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা।

১৪ জুলাই : গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ শেখ হাসিনা আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভের পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন। মিছিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও।

১৫ জুলাই : কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ঢাবি এলাকা। নিরীহ ছাত্রীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সাধারণ মানুষ। একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। সেইসঙ্গে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। দেওয়ালে দেওয়ালে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়।

১৬ জুলাই : ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছুই মনে রাখা হবে এবং জবাব দেওয়া হবে।’ এদিন রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং আনইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা। বন্ধ করে দেওয়া হয় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছয় জেলায় মোতায়েন করা হয় বিজিবি। 

১৭ জুলাই : ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতদের গায়েবানা জানাজা পড়ার সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা করে। এদিন বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন শেখ হাসিনা; উচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। রাতে যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ওই রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেসবুক।

১৮ জুলাই : আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে। মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়। এদিন মোট ৪১ জন নিহত হন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। 

১৯ জুলাই : এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এদিন সারা দেশে ৮৪ জন নিহত হন। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ।

২০ জুলাই : দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন। সাধারণ ছুটি ঘোষণা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। এদিন ৩৮ জন নিহত হন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ।

২১ জুলাই : আপিল বিভাগের শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ করার আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ের পরও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় কারফিউ অব্যাহত থাকে, সাধারণ ছুটির আওতায় স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়। আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের পর। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২২ জুলাই : কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দেন শেখ হাসিনা।

২৩ জুলাই : কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি। রাতে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু।

২৪ জুলাই : ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আরও চারজনের মৃত্যু। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। নিখোঁজ থাকার পাঁচ দিন পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান দুজন। নির্বাহী আদেশে তিন দিন সাধারণ ছুটির পর অফিস খোলে।

২৫ জুলাই : চিকিৎসাধীন আরও তিনজনের মৃত্যু। অ্যামনেস্টি প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ। শেখ হাসিনার মেট্রোস্টেশন পরিদর্শন। বললেন, ‘আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।’

২৬ জুলাই : নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ডিবি। আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যান শেখ হাসিনা। পুলিশের গুলিতে শত শত মানুষের হতাহত হওয়া নিয়ে দুঃখপ্রকাশ না করে শেখ হাসিনা ওখানে গিয়ে কেঁদেছেন। তার এ ভূমিকাকে ‘নাটক’ আখ্যা দেন অনেকে। কান্নারত শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে বানানো মিম ছড়িয়ে পড়ে, যার ক্যাপশন ছিল ‘নাটক কম কর পিও’।

২৭ জুলাই : কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। 

২৮ জুলাই : ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডিবির হেফাজতে সমন্বয়কদের গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশ যদি মনে করে তারা ঝুঁকিমুক্ত, তখনই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট সচল।

২৯ জুলাই : জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে। সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সরকার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এর বদলে একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা।

৩০ জুলাই : হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙিয়েছেন অনেকে। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের।

৩১ জুলাই : এদিন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেফতার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে, জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি ঘোষণা কর। কর্মসূচি পালনের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতগুলোর স্মৃতিচারণ, শহিদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার এবং সহপাঠীদের স্মৃতিচারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হওয়া নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে চিত্রাঙ্কন/গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন তৈরি, ডিজিটাল পোর্ট্রটে তৈরি প্রভৃতি।’

৩২ জুলাই (১ আগস্ট) : এদিন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেও কুমিল্লা, নারায়াণগঞ্জ ও বরিশালে সংঘাত আর রক্তপাত হয়। কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার।

৩৩ জুলাই (২ আগস্ট) : এদিন আন্দোলনে ছাত্র হত্যার বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পী সমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ।

৩৪ জুলাই (৩ আগস্ট) : এদিন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা। সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘বিক্ষোভ মিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুজন নিহত হন। শিক্ষার্থী, পুলিশ, সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক, অভিভাবক, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে অংশ নেন। এদিন বিকালে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জড়ো হন। এতে জনসমুদ্রে রূপ নেয় শহিদ মিনার এলাকা। সে জমায়েত থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি আসে।

৩৫ জুলাই (৪ আগস্ট) : এদিন সরকার পতনের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে মাঠে নামার ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সারা দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। জীবন হারান কমপক্ষে ১০৪ জন। আহত হন কয়েক হাজার। সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। এ ছাড়া তিন দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় আদালতের কার্যক্রম। শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে পরদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) : এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালিত হয়। কারফিউ ঘোষণা থাকায় সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে। সকালে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে পুলিশের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করে ও গুলি চালায়। সকাল ১০টার পর থেকেই উত্তরা এবং যাত্রবাড়ী দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে হাজারো মানুষ। দুপুর নাগাদ শেখ হাসিনার পতনের কথা শোনা যায়। দুপুর পর রাজপথগুলো গণজোয়ারে পরিণত হয়। এদিনও ৮৮ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যেই খবর আসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। রাজপথে শুরু হয় বিজয় উল্লাস, ভিড় জমে মিষ্টির দোকানে। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে বিজয়ী ছাত্র-জনতা। অবসান হয় ফ্যাসিবাদের!! 

লেখক: অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম