আরবি ভাষার বহুমাত্রিকতা ও গৌরব পুনরুদ্ধার
ফারহান আহমদ তাওসীফ
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ পিএম
১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। ইউনেস্কো স্বীকৃত ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে পালিত হয়ে আসা দিবসটি মূলত আরবি ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম আরবি ভাষা। বিশ্ব সাহিত্যে আরবির স্থান অতি উচ্চ। আজ থেকে আড়াই তিন হাজার বছর পূর্বে রচিত আরবি কবিতাগুলোর সাহিত্যরস এখনো সাহিত্য পিপাসুদের চিত্তাকর্ষণের খোরাক।
আরবি ভাষা কোন ধর্মীয় ভাষা না হলেও ইসলাম ধর্ম আরবি ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষায় উন্নীত করেছে। যেহেতু ইসলাম ধর্মের মৌলিক দুটি বিষয় তথা কুরআন ও হাদিস আরবি ভাষায় বর্ণিত হয়েছে; এজন্য মুসলিম মাত্রই আরবি ভাষার প্রতি মুখাপেক্ষী।
ধর্মীয় দিক ব্যতীত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাহিত্য ইত্যাদির সমন্বয়ে আরবি ভাষার রয়েছে এক বিশাল, গৌরবময়, সমৃদ্ধ সাহিত্য ভান্ডার। এই সাহিত্য ভান্ডারের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু সংখ্যাধিক্যেই নয় বরং এর গুণগত মান বিশ্বের যে কোন সাহিত্যের তুলনায় অনন্য। এই সজীব সাহিত্য ভান্ডারের কারণে আরবি ভাষা একটি জীবন্ত ও সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে আরবি ভাষার একটি বিশাল দখল রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগ তথা মধ্যযুগে আরবি ভাষায় জ্ঞানের বিস্তার। মধ্যযুগীয় বড় বড় মনীষীগণ আরবি ভাষায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাস্ত্রের বড় বড় গ্রন্থ রচনা করেছেন, যে গ্রন্থগুলো বিশ্বের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মূলত আরবি ভাষার বিস্তৃতি সাধনে এই মধ্যযুগীয় মনীষীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের বহুমাত্রিক বিচরণ আরবি ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসার কাজটি করেছে। একই সময়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনাতেও মনীষীগণ পূর্ণ মনোনিবেশ করেছিলেন। যার ফলে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নবিদ্যার পাশাপাশি দর্শন, অলংকারশাস্ত্র ও যুক্তিশাস্ত্রের উপর তাঁদের অত্যন্ত মূল্যবান কাজ লক্ষ্য করা গেছে।
এই বহুমুখী প্রতিভাধারী মনীষীদের মধ্যে আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা এবং আল-খাওয়ারেজমির মতো বিজ্ঞানীরা তৎকালীন খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি ভাষায় অভূতপূর্ব জ্ঞানভাণ্ডার সৃষ্টি করেছিলেন। আব্বাসীয় খিলাফতকাল পর্যন্ত আরবি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় ভাষা।
বায়তুল হিকমার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল গ্রিক, রোমান, পারসিক, ভারতীয় এবং চৈনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্লাসিক্যাল গ্রন্থগুলো। বীজগণিত, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোলের মতো বহু শাখায় আরবি ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলো পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের স্বর্ণযুগ পার করা আরবি ভাষা বর্তমানে একধরনের উপেক্ষার শিকার। আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের প্রাক্কালে আমরা আজকে জানব যে, কেনো এই ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার নেতৃত্ব হারালো এবং কীভাবে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বিভাজন এবং উপনিবেশবাদের প্রভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে ইসলামের প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। আর এরই মাধ্যমে ইসলামের শাস্ত্রীয় ভাষা আরবি ভাষার ঐতিহ্য, এবং সাহিত্য রচনার ধারা হ্রাস পেতে শুরু করে। মূলত মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরবি ভাষা চর্চা থেকে দূরে সরে যাওয়া ইসলাম ও মুসলমানদের এবং আরবি ভাষার বিশ্বনেতৃত্ব হারানোর অন্যতম কারণ।
ষোড়শ থেকে একবিংশ শতাব্দীকালে প্রচলিত পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিশ্বে আরবি ভাষার শিক্ষাব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল হয়ে পড়ে। পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় ভাষায় ইসলাম অধ্যয়নের প্রতি মুসলিম সমাজ ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ে।
মুসলিমরা সেসময় অন্য ভাষায় ইসলাম ও অন্যান্য জ্ঞানবিজ্ঞান শিখতে অগ্রসর হয়। যার ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবি সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজে পরিণত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে গ্রিক, পার্সিয়ানসহ বিভিন্ন ভাষার পুস্তকাদি আরবিতে অনূদিত হতো। কিন্তু পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে উদ্যোগের অভাব ভাষাটিকে পিছিয়ে দেয়। এছাড়া আরব দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ও বিভক্তি আরবি ভাষার উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরব সরকারগুলোর প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ আরব ও মুসলিমদের হাতে না থাকায় তা পরিপূর্ণভাবে পশ্চিমাদের ভাষায় প্রচারিত এবং প্রসারিত হয়েছে। যার ফলে আরবি ভাষা তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে এবং ইউরোপীয় ভাষাগুলো আরবি ভাষার তুলনায় বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় অধিকতর অগ্ৰসর হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের প্রেক্ষিতে আরবি ভাষার হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কাজে মনোনিবেশ করা এখন সময়ের দাবি। তবে এক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে আরবি ভাষায় পুনরায় বিজ্ঞানচর্চা জোরদার করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আল-জাজিরা ও অ্যারাবিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আধুনিক আরবি জ্ঞানচর্চাকে তুলে ধরছে। এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়াগুলো ইংরেজি ভাষার উপর নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টায় রত। শুধু আরববিশ্ব নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও এখন মুসলিম সমাজের উচিত আরবি ভাষার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সম্মিলিত ভূমিকা রাখা।
আরবি ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব হারানোর এই ইতিহাস মূলত একটি শিক্ষা। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ভাষা কেবল যোগাযোগের একটি মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের মূল। আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের এই মুহূর্তে আমাদের সংকল্প নেওয়া উচিত, আমরা আরবি ভাষাকে কেবল ধর্মীয় বা সাহিত্যিক মাধ্যম নয় বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনব।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে নেতৃত্বের আসনে আমরা যদি আরবি ভাষাকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে তা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নেতৃস্থানীয় আসনে আরবি ভাষাকে ও ইসলামকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে যার ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা বিশ্বনেতৃত্বের আসনে পুনরায় ফিরে আসতে পারবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়