Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

অমুসলিমদের সঙ্গে নবীজির প্রেমময় ব্যবহার

Icon

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৯ পিএম

অমুসলিমদের সঙ্গে নবীজির প্রেমময় ব্যবহার

বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীকে যে মহামানব সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন, সেই মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার মূর্তপ্রতীক। 

মানবপ্রেম ছিল তার মূলশক্তি। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, হৃদ্যতা সৃজনের লক্ষ্যেই তাঁর আগমন। তিনি মানুষকে বিভক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। 

তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ। আজকের বকধার্মিকদের মতো তিনি অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করতেন না। বরং বলতেন, ‘আমাদের অপরাধের জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু কর, সে সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞাসিত হব না।’ 

অমুসলিমরা তাঁকে পাগল ডাকত, আঘাত করত। কঠোর ভাষায় কথা বলত। অথচ নবীজি তাদের সঙ্গে এমন কোমল প্রেমময় আচরণ করতেন, যা কেবল নিজ পরিবারের সঙ্গেই করা হয়ে থাকে। এ জন্যই তো আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতেন, তবে তারা আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যেত।’ (সূরা আল ইমরান : ১৪৯)।

মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবেই সম্মান কররতেন। সম্মান করার শিক্ষা দিতেন। এমনকি সে যদি কোনো ইহুদির লাশও হয়, তবুও তার সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে যেতেন। 

একবার নবীজির পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তা দেখে দাঁড়ালেন। উপস্থিত সাহাবারা বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। নবীজি তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহইসান নাফসা? অর্থাৎ, সেকি মানুষ নয়?’ ( বুখারি : ১৩১২)।

তরবারির ভয়ে নয়, মুহাম্মদ (সা.)-এর কোমলচিত্ত আর দরদী কণ্ঠের মাধুর্যেই লোকেরা দলে দলে শান্তির ধর্ম ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহহও তার প্রতি দয়া করে না।’ (মুসলিম : ২৩১৯)।

এখানে উপলব্ধির বিষয় হল, নবীজি তাঁর অমূল্য বাণীতে ‘মুসলিম’ শব্দ উচ্চারণ না করে, সর্বজনীনভাবে ‘মানুষ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। কারণ তাঁর আদর্শ ছিল ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। মানবপ্রেমই বড় ধর্ম। অথচ কিছু মানুষ নামের অমানুষেরা নবীজিকে অমানবিক, সন্ত্রাসী, খুনি হিসেবে উপস্থাপন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, মুহাম্মদ (সা.) জীবনে অনেক যুদ্ধ পরিচালিত করেছেন। তবে তা সাম্রাজ্য বিস্তার বা কোনো ধন-সম্পদ অর্জনের লোভে নয়। 

আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে যখন এ পৃথিবী, পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই জাহেলিয়াতকে দূর করতে এবং সত্য-সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছিলেন। বর্বর আরবদের সভ্য করতে এ যুদ্ধগুলোর খুবই প্রয়োজন ছিল।

 নতুবা ওদের পশুত্ব মনন আজীবনই নিকৃষ্ট থেকে যেত। হানাহানি, মারামারি, রক্তারক্তি, কাফেলা লুট, নারী নির্যাতনসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকত। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও তিনি অমুসলিমদের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন, ইতিহাসে তা বিরল। 

যুদ্ধের ময়দানেও তিনি অমুসলিমদের সম্মান দেখাতেন 

মুহাম্মদ (সা.) জীবদ্দশায় ২৭টির মতো বড় যুদ্ধ ও ৬০টির মতো ছোটখাটো যুদ্ধ পরিচালনা করার পরও কাউকে নিজ হাতে কতল করেননি। মূলত তিনি ছিলেন অহিংসুক মতাদর্শের। তাই যুদ্ধের ময়দানেও অমুসলিমদের মধ্যে যারা নিরপরাধ ও ধর্মীয়বোধ সম্পন্ন, তাদের সম্মানে নিজ সৈনিকদের নির্দেশ দিতেন, ‘শিশু, বৃদ্ধ, নারী, ধর্মীয়দের এবং যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে যেন মুসলিম বাহিনী কোনো অস্ত্র না ধরে’। একইভাবে অমুসলিমদের প্রার্থনালয় ও সম্পদ যেন নষ্ট না হয় সে ব্যাপারেও ছিল কঠোর নির্দেশ তাঁর। 

যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে নবীজির মানবিক আচরণ 

নবীজির সমরনীতিতে অনর্থক রক্তক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না বলেই অল্প লোকক্ষয় ও সীমিত সময়ে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হতেন। যুদ্ধে যেসব অমুসলিম নিহত হতো, তাদের লাশ যেন বিকলাঙ্গ না করা হয়, সে ব্যাপারে নবীজি ছিলেন সদা তৎপর। আর যারা বন্দি হতো, তাদের সঙ্গেও করতেন কোমল ও সম্মানপূর্বক আচরণ। নবম হিজরিতে আরবের বনু তাঈ গোত্রের সঙ্গে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ হলে তাঈ গোত্র পরাজয় বরণ করে পালিয়ে যায়। কিছুসংখ্যক লোক বন্দি হয়। বন্দিদের মধ্যে পৃথিবী খ্যাতদাতা হাতেম তাঈয়ের মেয়েও ছিলেন। নবীজি তাকে ডেকে বললেন, ‘হে তাঈ কন্যা! তোমার বাবা ছিলেন ইমানদারের চরিত্রে উদ্ভাসিত। 

তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার ও দাতা চরিত্রের মানুষ। যাও, তার খাতিরে তোমাকে মাফ করে দিলাম।’ তাঈকন্যা তখন নবীজিকে অনুরোধ করেন, তার সঙ্গে যেন তার গোত্রের সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। নবীজি তাঈকন্যার সম্মান প্রদর্শনে সবাইকে মাফ করে দেন। এমনকি পথের খরচটুকুও দিয়ে দেন। 

যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ মওকুফ করতেন শিক্ষকতার বিনিময়ে 

অমুসলিমরা যেখানে মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করত, সেখানে নবীজি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিয়ে দিতেন সামান্য মুক্তিপণের বিনিময়ে। আর যারা এ সামান্য মুক্তিপণ দিতে পারতেন না, তাদের নিয়োগ দিতেন ভাষা শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে। বদর যুদ্ধে যেসব অমুসলিম বন্দি হয়ে মুক্তিপণ দিতে পারেননি, তাদের এ শর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন যে, তারা প্রত্যেকে দশজন মুসলমানকে আরবি ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ শেখাবেন। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যেন কোনো অমানবিক আচরণ না ঘটে, সে দিকে খেয়াল রাখার জন্য নবীজি সাহাবাদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘যে মুসলিম তার বন্দির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩২)। 

যুদ্ধের ময়দানেও নবীজি অমুসলিমদের জন্য দোয়া করতেন 

নবীজিকে হত্যা করার জন্য অমুসলিমরা কত ষড়যন্ত্রই না করেছিল। লেলিয়ে দিয়েছিল দুষ্ট বালকদের। যার পবিত্র শরীরে মশা-মাছি বসাকে হারাম করা হয়েছে, সেই নবীজির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তায়েফের জমিন। উহুদের ময়দানে হারাতে হয়েছে পবিত্র দাঁত। তারপরও তিনি তাদের জন্য বদদোয়া করেননি। 

বরং সাহাবারা যখন রাসূল (সা.)-এর কাছে আবেদন জানাতেন, ‘হে আল্লাহহর রাসূল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহহর কাছে দোয়া করুন।’ তখন নবীজি রক্তাক্ত চেহারা মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমি অভিশাপ দেয়ার জন্য আসিনি, বরং আমি এসেছি ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।’ এরপর তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আমার মালিক! আমার লোকদের ক্ষমা করুন। তারা জানে না যে, তারা কী করছে।’ (মুসলিম : ২৫৯৯, ইবনে হিব্বান : ৯৮৫)।

অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় নবীজির নির্দেশ 

চিনের উইঘুর, ফিলিস্তিন, ভারতসহ প্রায় দেশেই সংখ্যালঘু মুসলমানরা নির্যাতিত। একইভাবে আমাদের দেশেও ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে কিছু নামধারি মুসলমান হিন্দু-বৌদ্ধদের ওপর চড়াও হয়। অথচ নবীজি এসব গর্হিত কাজ না করার জন্য কঠোর হুশিয়ারি করে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নীপিড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া) চাপিয়ে দেয়, অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষালম্বন করব।’ (মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার : ৫৭৫০)। 

যারা নবীজির আদেশকে অমান্য করে এসব গর্হিত কাজ করে, ইসলাম তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের জন্য জান্নাতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। নবীজি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না। অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি : ৩১৬৬)।  

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতিষ্ঠায় নবী মুহাম্মদ (সা)

ধর্মের নামে পৃথিবীতে এই যে এত কুন্দল, মারামারি, হানাহানি। এ সবের কিছুই হতো না, যদি নবীজির আদর্শকে গ্রহণ করা হতো। যেমন গ্রহণ করেছিলেন তাঁর সাহাবারা। তাদের সময়ে পৃথিবী হয়ে উঠেছিল বেহেশতের বাগান। তখন ধর্মের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামার চিহ্নমাত্র ছিল না। হবেই বা কেমন করে? 

নবীজি তো স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে, তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।’ ( আবু দাউদ : ৫১২৩)। 

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বপ্নদ্রষ্টা নবী মুহাম্মদ (সা.) আজীবন যে মানবপ্রেমের দীক্ষা দিয়েছেন, তার মধ্যেই লুকায়িত জীবনের সফলতা। তিনি আধ্যাত্মচেতনা আর প্রেমের মাধুর্যে যে বাগান সাজিয়েছিলেন, সেই বাগান আজ অন্যদের দখলে। সে জন্যই পৃথিবী অসুস্থ। নবীজির আদর্শকে গ্রহণ করলেই পৃথিবী ফিরে পাবে তার হারানো সুদিন। শাশ্বত প্রেমের অমিয় ধারায় হয়ে উঠবে বেহেশতের বাগান।

লেখক: প্রাবন্ধিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম