Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ছয়শ বছরের অটোমান সাম্রাজ্য

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম

ছয়শ বছরের অটোমান সাম্রাজ্য

জহির-উদ-দীন বাবর ভালো করেই জানতেন যে তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা শত্রু বাহিনীর তুলনায় আট ভাগ কম, তাই তিনি এমন একটি পদক্ষেপ নেন, যা ইব্রাহিম লোদি কল্পনাও করতে পারেননি।

বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার মুসলিম সম্রাট ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আর সেই পানিপথের যুদ্ধে অটোমান তুর্কিদের যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করেছিলেন বাবর। খবর বিবিসি বাংলার। 

অটোমানদের উপহার যুদ্ধ কৌশল
তুর্কি অটোমানের যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী বাবরের বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে প্রথম সারিতে চামড়ার দড়ি দিয়ে সাতশ গরুর গাড়ি বাঁধেন।

তাদের পেছনেই বসানো হয় যুদ্ধ কামান। বলে রাখা ভালো, এটি ছিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ এবং এর আগে ভারতের কোনও যুদ্ধে কামানের ব্যবহার হয়নি। কামানের বিষয়ে অনেকে তখন জানতোই না। শুরুর দিকে এই কামানগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা খুব একটা ভালো ছিল না।

তবে বাবর বাহিনী কামান থেকে নির্বিচারে গোলাবর্ষণ শুরু করলে এর আকস্মিক কানফাটানো বিস্ফোরণ ও ধোঁয়ায় আফগান বাহিনী বিভ্রান্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করে।

অথচ ইব্রাহীম লোদির বাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্য ছাড়াও এক হাজারের মতো যুদ্ধ হাতি বা গজবাহিনী ছিল, কিন্তু সৈন্যদের মতো ‌এই হাতিগুলোও আগে কখনও কামানের বিস্ফোরণ শোনেনি।

এ কারণে কামান থেকে গোলা বিস্ফোরণের সাথে সাথে হাতিগুলো যুদ্ধে অংশ নেয়ার পরিবর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, ধোঁয়ায় সবার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। 

অন্যদিকে, বাবরের ১২ হাজার প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করা যোদ্ধারা এমন মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা বিদ্যুতের গতিতে এগিয়ে গিয়ে লোদির সেনাবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বাবরের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ইতিহাসবিদ পল কে. ডেভিস তার বই ‘হান্ড্রেড ডিসাইসিভ ব্যাটেলস'-বইটিতে এই যুদ্ধকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সেই থেকেই মহান মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল।

অটোমান বা উসমানীয় যুদ্ধ কৌশল ছাড়াও বাবরের ওই যুদ্ধে দুই তুর্কি গোলা নিক্ষেপকারী ওস্তাদ আলী ও মুস্তফা এই বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বাবরকে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খলিফা সেলিম তার ওই দুই সেনাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, অটোমান সাম্রাজ্য ১৩ শতকে উসমান গাজীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং আনাতোলিয়া অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়েছিল।

উল্লেখ্য, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বর্তমান ইতালি, গ্রিস ও তুরস্ক আর উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। অন্যদিকে, আনাতোলিয়া হচ্ছে বর্তমান তুরস্কের বড় একটি অংশ।

উসমান গাজী, ১২৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সোগুত নামে ছোট একটি রাজ্যের তুর্কি সেনাপতি ছিলেন তিনি। একদিন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবেন।

উসমানের স্বপ্ন
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন ফিঙ্কেল তার 'উসমানস ড্রিম' বইতে লিখেছেন যে উসমান এক রাতে শেখ আদিবালি নামে এক বৃদ্ধ দরবেশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।

ওই রাতে উসমান স্বপ্ন দেখেন যে তার বুক থেকে একটি বিশাল গাছ বেরিয়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে এবং সারা বিশ্বে ছায়া ফেলছে।

উসমান পরে শেখ আদিবালীর কাছে তার এই স্বপ্নের কথা জানান। শেখ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: "হে উসমান, বাবা আমার, ধন্য হও, আল্লাহ তোমাকে এবং তোমার বংশধরদের কাছে রাজকীয় সিংহাসন অর্পণ করেছেন।"

এই স্বপ্নটি উসমান গাজীর জন্য একটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি এখন ঈশ্বরের সমর্থন পেয়েছেন।

তারপর আনাতোলিয়ার বেশিরভাগ অংশ জয় করে, আশেপাশের সেলজুক ও তুর্কোমান রাজ্যসহ বাইজেন্টাইন দখল করে নেন।

উসমানের স্বপ্নটি পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের যৌক্তিকতা এবং একইসঙ্গে মিথ বা পৌরাণিক কথায় পরিণত হয়। এই অটোমান সাম্রাজ্য ছয়শ' বছর ধরে শাসন করেছে। এমন দীর্ঘ সময় ধরে তারা কেবল আনাতোলিয়া নয়, বরং তিনটি মহাদেশের বিশাল অংশ শাসন করে গিয়েছে।

উসমানের স্বপ্ন
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন ফিঙ্কেল তার 'উসমানস ড্রিম' বইতে লিখেছেন যে উসমান এক রাতে শেখ আদিবালি নামে এক বৃদ্ধ দরবেশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।

ওই রাতে উসমান স্বপ্ন দেখেন যে তার বুক থেকে একটি বিশাল গাছ বেরিয়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে এবং সারা বিশ্বে ছায়া ফেলছে।

উসমান পরে শেখ আদিবালীর কাছে তার এই স্বপ্নের কথা জানান। শেখ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: "হে উসমান, বাবা আমার, ধন্য হও, আল্লাহ তোমাকে এবং তোমার বংশধরদের কাছে রাজকীয় সিংহাসন অর্পণ করেছেন।"

এই স্বপ্নটি উসমান গাজীর জন্য একটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি এখন ঈশ্বরের সমর্থন পেয়েছেন।

তারপর আনাতোলিয়ার বেশিরভাগ অংশ জয় করে, আশেপাশের সেলজুক ও তুর্কোমান রাজ্যসহ বাইজেন্টাইন দখল করে নেন।

উসমানের স্বপ্নটি পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের যৌক্তিকতা এবং একইসঙ্গে মিথ বা পৌরাণিক কথায় পরিণত হয়।

এই অটোমান সাম্রাজ্য ছয়শ' বছর ধরে শাসন করেছে। এমন দীর্ঘ সময় ধরে তারা কেবল আনাতোলিয়া নয়, বরং তিনটি মহাদেশের বিশাল অংশ শাসন করে গিয়েছে।

প্রথম উসমানীয় খলিফা
এরপর বিজয়ী মেহমেতের নাতি ‘প্রথম সেলিম’ অন্যান্য দিকে দৃষ্টিপাত করেন।

তিনি ১৫১৬ ও ১৫১৭ সালে মিশরের মামলুকদের পরাজিত করে, মিশর ছাড়াও বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডানসহ সর্বোপরি হিজাজ জয় করে তার সাম্রাজ্যের আকার দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফেলেন।

এর পাশাপাশি, আজ থেকে ঠিক পাঁচশ বছর আগে হিজাজের দুটি পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা অধিগ্রহণ করে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হয়েছিলেন প্রথম সেলিম।

ধারণা করা হয়, উসমানীয় খিলাফত ১৫১৭ সালে শুরু হয়েছিল, এবং প্রথম সেলিমকে প্রথম খলিফা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তার আগ পর্যন্ত উসমানীয়দের 'সুলতান' বা 'পাদশাহ্' বলা হতো।

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার 'ইস্যু অফ খিলাফত' বইতে লিখেছেন: 'সুলতান সেলিম খান প্রথমের সময় থেকে আজ পর্যন্ত অটোমান তুর্কি সুলতানরা সব মুসলমানের খলিফা ও ইমাম ছিলেন।’

‘এই চার শতাব্দীর মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে খিলাফতের দাবিদারও উঠেনি। সরকারের কাছে শত শত খলিফা দাবিদার উঠেছে ঠিকই কিন্তু কেউ ইসলামের কেন্দ্রীয় খিলাফত দাবি করতে পারেনি।’

প্রথম সেলিমের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক সাম্রাজ্য দখল করতে পারতেন। এর বড় কারণ ছিল তার কার্যকর যুদ্ধ কৌশল।

পানিপথের যুদ্ধে তার এই রণকৌশল অনুসরণ করে ওই যুদ্ধে প্রথম গোলা বারুদ ব্যবহার করেন সম্রাট বাবর।

ওই যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদিকে হারানোর পরই মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবর।

হুমায়ুন বনাম খলিফা
বাবরের উত্তরসূরি হুমায়ুনও অটোমানদের এই অনুগ্রহের কথা মনে রেখেছিলেন। সেলিমের ছেলে সালমান আলিশানকে লেখা একটি চিঠিতে হুমায়ুন লেখেন:

'খিলাফতের মর্যাদার ধারক, মহানতার স্তম্ভ, ইসলামের ভিত্তির রক্ষক সুলতানের জন্য শুভ কামনা। আপনার নাম সম্মানের সিলমোহরে খোদাই করা হয়েছে এবং আপনার সময়ে খেলাফত নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। মহান আল্লাহ যেন আপনার খেলাফত অব্যাহত রাখেন।'

হুমায়ুনের ছেলে আকবর অবশ্য উসমানীয়দের সাথে কোনও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেননি।

যার কারণ সম্ভবত এই যে, ইরানের সাফাভিদ শাসকদের সাথে অটোমানরা তখন ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং আকবর সাফাভিদ শাসকদের ক্ষেপাতে চাননি।

তবে আকবরের উত্তরসূরি শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের অটোমান সুলতানদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল।

উপহার বিনিময় আর কূটনৈতিক মিশন তাদের মধ্যে সাধারণ বিষয় ছিল এবং তারা তাকে সমস্ত মুসলমানদের খলিফা বলে মনে করতেন।

শুধু মুঘলরা নয়, অন্যান্য ভারতীয় শাসকরাও অটোমানদেরকে তাদের খলিফা হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং ক্ষমতায় আসার পর তাদের কাছ থেকে আনুগত্য নেওয়া জরুরি বলে মনে করতেন।

টিপু সুলতান মহীশুরের শাসক হওয়ার পর, তিনি তৎকালীন অটোমান খলিফা তৃতীয় সেলিমের কাছ থেকে তার শাসনের জন্য সমর্থন চাইতে কনস্টান্টিনোপলে একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন।

তৃতীয় সেলিম টিপু সুলতানকে তার নাম সম্বলিত একটি মুদ্রা টাঁকশাল করতে এবং শুক্রবারের খুতবায় তার নাম পাঠ করার অনুমতি দেন।

তবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য টিপু সুলতান যখন সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন তখন অটোমান খলিফা সেই অনুরোধ গ্রহণ করেননি।

কারণ সে সময় তিনি নিজে রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তখন শক্তিশালী ব্রিটিশ শত্রুদের পরাস্ত করা বেশ কঠিন হতো।

সুলতান সুলেইমান
অটোমানরা শুরুতে ইউরোপের অনেক অঞ্চল দখল করে। তবে এই সাম্রাজ্য রাজনীতি, রণনীতি, অর্থনীতি - এই তিনটি ক্ষেত্রেই সবচেয়ে প্রসার লাভ করে প্রথম সুলেইমানের আমলে।

তিনি ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সালে টানা ৪৫ বছর আমৃত্যু শাসনভারে ছিলেন।

সুলেইমান আলী খানের শাসনামলে সালতানাত বা অটোমান সাম্রাজ্য তার সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শীর্ষে পৌঁছেছিল।

এ কারণে তিনি পশ্চিম ইউরোপে 'সুলেইমান দ্য মেগনিফিসেন্ট' নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, নিজ সাম্রাজ্যে তাকে বলা হতো কানুনি সুলতান।

বেলগ্রেড ও হাঙ্গেরি জয় করে সুলেইমান তার সীমানা মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন। তবে দুবার চেষ্টা করেও অস্ট্রিয়ার বিলাসবহুল শহর ভিয়েনা জয় করতে পারেননি তিনি।

(যাকে ঘিরে তুরস্কের জনপ্রিয় সিরিয়াল সুলতান সুলেইমান নির্মাণ করা হয়েছে। সিরিয়ালটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে।)

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম