নতুন কোনো কাজ শুরু করার আগে ইসতিখারা করতে হয়। এ জন্য কল্যাণ কামনায় ইঙ্গিত পেতে ইসতিখারা নামাজ পড়া আবশ্যক।
আরবি ইসতিখারার অর্থ হলো- কল্যাণ প্রার্থনা করা বা এমন কিছু প্রার্থনা করা যাতে কল্যাণ রয়েছে। তাই কাজটি কল্যাণ হবে কিনা ইশারা-ইঙ্গিত পেতে ইসতিখারার নিয়তে দুই রাকাআত নামাজ ও দোয়া পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বিশেষ প্রার্থনাই হলো ইসতিখারা।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইসতিখারার আমল শিক্ষা দিয়েছেন।
সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কুরআনের সূরা যেভাবে শেখাতেন, সকল বিষয়ে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) সেভাবে ইসতিখারা করতে শিখিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১১৬৬)
অর্থাৎ কুরআনের আয়াত যেভাবে মুখস্থ করিয়েছেন সেভাবেই ইসতিখারার আমল শিক্ষা দিয়েছেন এবং ইসতিখারার দোয়া মুখস্থ করিয়েছেন।
ইসতিখারা শব্দের অর্থ হল, খাইর বা কল্যাণ প্রার্থনা করা। অর্থাৎ যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আগে ওই বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা এবং দোয়া করা যে, হে আল্লাহ! যেভাবে এই কাজ করলে আমার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ হবে, সেইভাবে কাজটি করার তাওফীক দান করুন।
তার জন্য সহায়ক সকল আসবাবের ব্যবস্থা আপনি করে দিন এবং আমার মনকে সেদিকে ঝুঁকিয়ে দিন। আর যেভাবে করলে অকল্যাণ হবে, সেভাবে করা থেকে আমাকে বিরত রাখুন এবং আমার মনকে আপনার ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট করে দিন। মনের দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা দূর করে দিন।
দুই রাকাত নামাজ পড়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো বিশেষ একটি দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে কল্যাণ চাওয়াকে ইসতিখারা বলে। ইসতিখারা করা সুন্নাত।
দ্বীন-দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো কাজ এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে কর্তব্য হল-
প্রথমে আল্লাহ প্রদত্ত আকল ও বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করা। সেই কাজ ও সিদ্ধান্তের নানা দিক বিবেচনা করে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং উপকারী-অনোপকারী বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা।
এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দোয়ার মাধ্যমে ইসতিখারা করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা।
এর সঙ্গে সঙ্গে আপনজন, ঘনিষ্ঠজন, হিতাকাঙ্খী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে মশওয়ারা বা পরামর্শ করা।
ইসতিখারার পদ্ধতি ও দোয়া
সহিহ বুখারিসহ হাদিসের নির্ভরযোগ্য অনেক কিতাবে হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা করবে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এরপর বলবে-
اَللّٰهُمّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الغُيُوْبِ، اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ، ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ. وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِيْ بِه.
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসতাখিরুকা বিইলমিকা ওয়া আসতাকদিরুকা বিকুদরাতিকা ওয়া আসআলুকা মিন ফাদলিকাল আজিমি ফাইন্নাকা তাকদিরু ওয়া লা আকদিরু ওয়া তালামু ওয়া লা আলামু ওয়া আংতা আল্লামুলগুয়ুব; আল্লাহুম্মা ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা (এখানে নিজের ইচ্ছা, কাজ বা পরিকল্পনার কথা বলা)
খাইরুন লি ফি দ্বীনি ওয়া মায়িশাতি ওয়া আক্বিবাতি আমরি ফি আঝিলি আমরি ফি আঝেলে আমরি ওয়া আঝেলিহি ফাইয়াসসিরহু লি ছুম্মা বারিক লি ফিহি ওয়া ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা (এখানে নিজের ইচ্ছা, কাজ বা পরিকল্পনার কথা বলা)
শাররুন লি ফি দ্বীনি ওয়া মায়িশাতি ওয়া আক্বিবাতি আমরি ফি আঝেলে আমরি ওয়া আঝেলিহি ফাসরিফহু আন্নি ওয়াসরিফনি আনহু ওয়াক্বদুরলিয়াল খাইরা হাইছু কানা ছুম্মা আরদিনি বিহি।’ (এখানেও নিজের ইচ্ছা, কাজ বা পরিকল্পনার কথা বলা)
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার ইলমের ওসিলায় আপনার কাছে (আমার উদ্দিষ্ট বিষয়ের) কল্যাণ চাই এবং আপনার কুদরতের ওসিলায় আপনার কাছে (কল্যাণ অর্জনের) শক্তি চাই, আর আপনার কাছে চাই আপনার মহা অনুগ্রহের কিছু। কেননা, (সকল বিষয়ে) আপনার ক্ষমতা রয়েছে, আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনি (সবকিছু) জানেন, আমি কিছুই জানি না। আপনি তো আল্লামুল গুয়ূব-গায়েবের সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। (অর্থাৎ আমার কাঙ্খিত বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর কি না- তা আপনিই জানেন, আমি জানি না।)
হে আল্লাহ! আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে যদি এ বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর বলে জানেন, তাহলে আমার ভাগ্যে তা নির্ধারণ করে দিন এবং বিষয়টিকে আমার জন্য সহজ করে দিন। এরপর তাতে আমার জন্য বরকত দান করুন।
আর যদি বিষয়টি আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণাম বিচারে আমার জন্য ক্ষতিকর বলে জানেন, তাহলে আপনি তা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আর আমার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন; তা যেখানেই হোক। অতপর তাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হয়ে যাই সেই তাওফীক দান করুন।
তিনি ইরশাদ করেন, দোয়াটির যে দুই জায়গায় هَذَا الأَمْرَ শব্দ আছে, সেখানে নিজ প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে। (কিংবা অন্তত মনে মনে কল্পনা করবে।) (সহিহ বুখারি, হাদিস ১১৬৬, ৬৩৮২, ৭৩৯০; জামে তিরমিযী, হাদিস ৪৮০ ; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৩৮)
অনেকের ধারণা-ইসতিখারা করার সময় হল রাতে, ঘুমুতে যাওয়ার আগে। ধারণাটি ঠিক নয়। ইসতিখারা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই বরং যখন প্রয়োজন হবে তখনই ইসতিখারা করবে। তাতে রাত-দিন বা ঘুমানো-জাগ্রত থাকার কোনো বিষয় নেই।
সংক্ষিপ্ত ইসতিখারা
ইসতিখারার যে সুন্নত পদ্ধতিটি বর্ণনা করা হল সেটি তখনকার জন্য প্রযোজ্য যখন এই নিয়মে ইসতিখারা করার সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ইসতিখারার নিয়তে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ইসতিখারার মাসনূন দোয়াটি পড়া যায়। কিন্তু অনেক সময় তো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
কিংবা দুই রাকাত নামাজ পড়ে ওই দোয়াটি পাঠ করার মতো সময় ও সুযোগ পাওয়া যায় না। তখনকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত দোয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন।
দোয়াটি হল-
اللّهُمّ خِرْ لِي وَاخْتَرْ لِي.
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. তার বাবা হযরত আবু বকর রা. থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতেন এই দোয়া পড়তেন। দোয়াটির অর্থ হল, হে আল্লাহ! আমাকে কল্যাণ দান করুন এবং আমার জন্য আপনিই নির্বাচন করে দিন (কোন্ বিষয়টি আমার অবলম্বন করা উচিত)। -জামে তিরমিযী, হাদিস ৩৫১৬
এক্ষেত্রে পড়ার মতো আরেকটি দোয়া হল-
اللهُمّ اهْدِنِي وَسَدِّدْنِي.
হে আল্লাহ! আমাকে পথ প্রদর্শন করুন এবং সঠিক পথে অবিচল রাখুন। (সহীহ মুসলিম, হাদিস ২৭২৫)
এমন আরেকটি মাসনূন দোয়া-
اللّهُمّ أَلْهِمْنِي رُشْدِي وَأَعِذْنِي مِنْ شَرِّ نَفْسِي.
হে আল্লাহ! আমার অন্তরে সঠিক পথের ‘ইলহাম’ করুন এবং নফসের মন্দত্ব থেকে আমাকে রক্ষা করুন। -জামে তিরমিযী, হাদিস ৩৪৮৩
এই দোয়াগুলোর মধ্য থেকে যেটি মনে আসবে পড়ে নিবে। এমনকি যদি আরবী দোয়া মুখস্থ না থাকে কিংবা মনে না আসে তাহলে নিজের ভাষায় আল্লাহকে বলবে, হে আল্লাহ! আমি দ্বিধান্বিত। আমাকে সঠিক পথ অবলম্বন করার এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তাওফীক দিন।
যদি মুখে বলা সম্ভব না হয় তাহলে মনে মনেই আল্লাহর কাছে আবেদন করবে, হে আল্লাহ! আমি এই সমস্যার সম্মুখীন। আমাকে সঠিক পথ বেছে নেওয়ার তাওফীক দিন। যে পথে আমার জন্য কল্যাণ নিহিত এবং যে পথ ধরে অগ্রসর হলে আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারব সে পথে অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দান করুন।