সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মহানবি (সা.)
জুবায়ের বিন মামুন
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:১৪ পিএম
সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিরাপত্তা বিধানে ন্যায়বিচার ও সুশাসন অপরিহার্য। মানুষ সৎপথে জীবন পারাপার করার জন্য, সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ইসলাম সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালার বাণী : ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষদানকারী হিসাবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সূরা মায়েদা : ৮)।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবি (সা.) নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। নিম্নে তার মৌলিক কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
হিলফুল ফুজুল সংগঠন
আরব ভূমিতে যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন আরব সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করছিল। এমনি এক ক্লান্তিলগ্নে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে এবং গোত্রীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পঁচিশ বছর বয়সে তার সমবয়সি কিছু যুবককে নিয়ে এ শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কেউ কেউ বলেন, এ সংগঠনটি ‘ওকাজ মেলার’ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়েছে। যা ইতিহাসে ‘হরবুল ফুজ্জার’ নামে খ্যাত। যদিও জাহেলি যুগের অন্যায়, অবিচার প্রতিরোধ করার জন্য হিলফুল ফুজুল গঠিত হয়। তবে মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বে গঠিত এ সংগঠনটির শিক্ষা সর্বকালের, সর্ব সমাজের যুবকদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষা ও পথনির্দেশক হয়ে রয়েছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম : ১/৮৭)।
একাত্মবাদের বাণী
গোটা আরব যখন পাপের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিল। মানবতার লেশমাত্রও ছিল না। এমনই এক জাহেলি সমাজে রাসূল (সা.) স্বীয় সাহাবিদের নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন খোদার ঐশী বাণী প্রচার-প্রসারে। ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত মানুষগুলোকে তাওহিদের আলোকোজ্জ্বল পথ দেখাতে। পৌত্তলিকদের কল্পিত কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করতে।
বানু আদ-দাইল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবি (সা.)কে ইসলামের শুরু যুগে যুল-মাজাজ বাজারে দেখেছি। তিনি ঘোষণা করছেন, ‘হে লোকসকল! বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তোমরা সফলকাম হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৯০০৪)।
নারীর মর্যাদা ও অধিকার
জাহেলি যুগে সর্বক্ষেত্রেই নারীজাতি ছিল পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত। নারীদের ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার করা হতো। যেমনিভাবে পশু-প্রাণী ও আসবাবপত্র বেচাকেনা হয়ে থাকে তৎকালীন নারীদেরও পণ্যসামগ্রীর মতো বেচাকেনা করা হতো। পুরুষ তাদের দাসী বৈ অন্য কিছু মনে করত না। অসহায় নারীদের মোকাবিলায় তারা ছিল বনজ হিংস্র প্রাণীর মতো।
এমনকি কন্যাসন্তানদের জ্যান্ত পুঁতে ফেলার মতো অসম্ভব প্রথাও সে সমাজে প্রচলিত ছিল। তাদের জন্য পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসাবে তাদের কোনো অংশ ছিল না। ফলে জাহেলিয়াতের সে সময়কার মানুষের ওপর কুরআনের এ নির্দেশ জারি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
আল্লাহতায়ালার বাণী : ‘নিজ দাসীদেরকে দুনিয়ার ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য ব্যভিচারে বাধ্য করো না। যদি তারা পূতপবিত্র থাকতে চায়।’ (সূরা নুর : আয়াত ৩৩) এবং নবি (সা.)ও নারীদের পৃথিবীর সর্বোত্তম বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবী মানুষের ভোগ্যবস্তু আর এর মধ্যে সর্বোত্তম হলো পুণ্যবতী স্ত্রী।’ (সুনানে নাসায়ী : ৩২৩২)।
নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিষিদ্ধতা
ইসলামপূর্ব যুগে আরবরা মাদক গ্রহণে তীব্রভাবে আসক্ত ও অভ্যস্ত ছিল। মদ্যপান হয়ে উঠেছিল তদের আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্য। নর্তকিদের সঙ্গে মদোমত্ত হয়ে তারা জঘন্যতম অশ্লীল কাজ করত। এমনকি জুয়া খেলাকে তাদের সম্মানজনক কাজ হিসাবে আখ্যায়িত করত। এতে সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো তুমুলভাবে।
ইসলাম আসার পর রাসূল (সা.) সাহাবিদের ক্রমানুসারে মদ্যপান করা এবং জুয়া খেলা থেকে বিরত থাকতে বলেন। অতঃপর একপর্যায়ে এ জাতীয় নেশাদ্রব্যকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য মদ এবং জুয়া হারাম করেছেন। (মুসনাদে আহমদ : ৪-২১৮)।
অতএব, সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে, নেশাদ্রব্যকে না বলতে হবে। নিজেদের পরিবার-পরিজনের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তানসন্ততিকে এ ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে। ইবাদতে মগ্ন করতে হবে।
জাকাতের বিধান প্রচলন
ইসলামের মৌলিক ভিত্তিগুলোর মধ্যে জাকাত অন্যতম। পবিত্র কুরআনে মাজিদে নামাজ কায়েম এবং জাকাত আদায়ের কথা সত্তরের বেশি জায়গায় একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামে নামাজ ও জাকাতের গুরুত্ব এক ও অভিন্ন। কারণ, এ জাকাতের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরিত করে সমাজের সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ দূর হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব। আল্লাহতায়ালার বাণী : ‘হে নবি! তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও বরকতপূর্ণ করবেন। (আয়াতাংশ, সূরা তাওবা : ১০৩)।
মহান আল্লাহ আমাদের জাকাতভিত্তিক সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন। পরিশেষে বলব, আমারা যদি বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি, তাহলে আমাদের ব্যক্তিজীবন, পরিবারজীবন, রাষ্ট্রজীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বত্র রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। যা বাস্তবিক অর্থে পৃথিবীতে আবার সোনালি যুগের সোনালি পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারবে।