কুরআনের মাধুর্য যেভাবে মুশরিকদেরও আকর্ষণ করত
মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ০২:৫২ পিএম
কুরআনুল কারীম আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কালাম। এর শব্দ-বাক্যে রয়েছে আসমানী নূরের ছটা ও অলৌকিক দ্যুতি। একজন মুমিন দিবানিশি স্নাত হতে থাকে কুরআনের অপার্থিব স্নিগ্ধ আলোয়। ঈমানী নূরে বিধৌত হয় তার দেহ-মন।
মহান আল্লাহ মুমিন বান্দার এ দৃশ্যটির চিত্রায়ণ করেছেন এ ভাষায়― বস্তুত মুমিনরা তো এমনই যে, যখন তাদের সামনে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তখন তাদের অন্তর শিউরে ওঠে। আর যখন তাদের সামনে তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয়। আর তারা তাদের রবের ওপর ভরসা রাখে।
তারা নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।
এরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের নিকট রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। ―সূরা আনফাল (৮) : ২-৪
তবে কুরআন যেহেতু সর্বজনীন তাই এর লালিত্য ও মাধুর্য স্পর্শ করে যায় মুমিন-কাফির নির্বিশেষে সবাইকে। এমনকি স্রষ্টার বিদ্রোহী গোলাম উদ্ধত মুশরিকের হৃদয়েও তা নাড়া দিয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে কুরআনের পথে ডাকতেন, কুরআন পড়ে পড়ে মানুষকে শোনাতেন। কাফেররা তখন এই কুরআনের বিরোধিতায় সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে অবতীর্ণ হত।
আল্লাহ তায়ালা তাদের অবস্থা কুরআনে বলে দিয়েছেন―আর কাফেররা (একে অন্যকে) বলে, এই কুরআন শুনো না এবং এর (পাঠের) মাঝে হট্টগোল করতে থাক, যাতে তোমরা জয়ী থাক। ―সূরা হামীম সাজদা (৪১) : ২৬
কিন্তু কুরআনের শক্তির বিরুদ্ধে কি কখনো জয়ী হওয়া যায়?! ফলে তারা দিনদিন পরাজিতই হতে থাকল।
কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করা যাবে?
একদিকে কুরআনের বিরোধিতা অপরদিকে তাদের অবস্থা ছিল―রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রকাশ্যে নামাজে তিলাওয়াত করতেন তখন কাফেররা দূরে সরে যেত। কিন্তু দূর থেকে আবার আড় কানে চুপে চুপে শোনার চেষ্টা করত। যখন কেউ দেখে ফেলত, আস্তে কেটে পড়ত। (দ্রষ্টব্য: আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৪/১৬৪)
মক্কার প্রতাপশালী মুশরিক নেতারা দিনের বেলায় কুরআনের ধ্বনি স্তিমিত করতে মরিয়া হলেও রাতের অন্ধকারে তাদের আচরণ ছিল ভিন্ন। যেই কুরআনকে মিটিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে তারা তৎপর ছিল, সেই কুরআনেরই তিলাওয়াত শুনতে তারা চলে আসত চুপে চুপে, রাতের অন্ধকারে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনভর কুরআনের দাওয়াত দিতেন আর রাতের আঁধারে একান্ত নিভৃতে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন কুরআন তিলাওয়াতে।
আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান ও আখনাস ইবনে শারীক। মক্কার তিন মুশরিক সরদার। নবীজী যখন রাতে নামাযে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করতেন তারা লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে চলে আসত কুরআন শুনতে। নবীজীর ঘরের বাইরে ঘাপটি মেরে বসে কান পেতে থাকত। সবাই একা একা আসত। কেউ কারো খবর জানত না। ভাবত―আমি একাই শুনতে এসেছি।
এভাবে সারা রাত তন্ময় হয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনত তারা।
একবারের ঘটনা। এভাবে তারা সারারাত কুরআন তিলাওয়াত শুনল। যখন ভোর ঘনিয়ে এল। চারিদিক ফর্সা হতে আরম্ভ করল। তড়িৎ ঘর পানে ছুট দিল। কিন্তু পথে তিনজন একে অপরের মুখোমুখি হয়ে গেল। অপ্রস্তুত অবস্থা। ধরা খেয়ে গেল সবাই সবার কাছে―তিন জনই একই অপরাধের অপরাধী! দিনভর যেই কুরআনের বিরোধিতায় যারা জোর প্রচারণা চালায় তারাই কিনা রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর অন্তরালে এভাবে কুরআন শুনতে আড়ি পেতে বসে!
সাধারণ জনতা ব্যাপারটা টের পেলে তো কুরআনের প্রতি তারা আরো ধাবিত হয়ে পড়বে! জনগণকে যেভাবে তারা ভুলভাল বুঝিয়ে কুরআনের সংস্পর্শ থেকে নিবৃত্ত রাখতে চাইছে―তা মাঠে মারা পড়বে। না না এরকম আর আসা যাবে না―তারা প্রতিজ্ঞা করল। নিজেরাই নিজেদের ভর্ৎসনা করে ঘরে ফিরে গেল।
দিন গড়িয়ে ফের রাত এল। চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল। সবাই সবার জায়গা থেকে চিন্তা করল, কাল যেহেতু সবাই ধরা পড়ে গিয়েছে তাই আজ তিলাওয়াত শুনতে কেউ যাবে না। আমি একা গিয়ে কিছুক্ষণ শুনে আসি। এভাবে তিনজনই একই চিন্তা নিয়ে প্রতিজ্ঞা ভেঙে চলে গেল কুরআন শুনতে। ভোরের আলো ফুটতেই একে অপরের হাতে আবার ধরা পড়ল। আবার আগের দিনের মতো নিজেদের ভর্ৎসনা করে যে যার মতো ঘরে চলে গেল। ওয়াদা করল, আর আসবে না।
তৃতীয় রাত। প্রথম ও দ্বিতীয় রাতের মতো কেউ বিছানায় থাকতে পারল না। অন্ধকার নেমে এলে আজও তারা লুকিয়ে লুকিয়ে চলে গেল কুরআন শুনতে। বরাবরের মতো দেখা হয়ে গেল তিনজনের। এখন তারা শক্ত হল। বলল, আমরা মজবুত প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ না হলে হবে না। এভাবে তারা পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরল। (দ্রষ্টব্য: সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩১৫; দালায়েলুন নুবুওয়াহ, বাইহাকী ২/২০৬; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৭৭)
কুরআনের যে আয়াত শুনে মুগ্ধ হয়েছিল উতবা
প্রিয় পাঠক! কী এমন আকর্ষণ রয়েছে কুরআনের তিলাওয়াতে, যার কারণে এমন চিহ্নিত কুরআনের শত্রু রাতের অন্ধকারে ঘরে থাকতে পারত না! বিছানায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পরিবর্তে সারারাত কষ্ট করে কুরআন শুনতে অস্থির হয়ে পড়ত! এটা ছিল মূলত কুরআনের অলৌকিকত্ব।
কুরআনের অপার্থিব মাধুর্য ও অনিন্দ্য লালিত্যে বিমোহিত থাকত মক্কার মুশরিকরা প্রতিনিয়ত। সরাসরি কুরআনের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও কুরআনের অলৌকিকত্বে তারা যারপরনাই আকর্ষণ বোধ করত।
কুরআনের বড় একটি মুজেযা হচ্ছে, উদ্ধত মুশরিক এবং কট্টর কাফেরও এর মাধুর্য ও অলৌকিকত্বে আন্দোলিত ও বিমোহিত হয়। আর এমন বাঘা বাঘা শিল্পী কবি-সাহিত্যিক এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও প্রতিভায় প্রসিদ্ধ দাপুটে অহংকারী সরদার শ্রেণির লোকেরা প্রভাবিত হওয়া―এ কথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, কুরআন একমাত্র আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম। মানবীয় কোনো বাণী নয়। কেননা কোনো ধরনের মানবীয় বাণীর সামনে পরাস্ত হবার পাত্র তারা ছিল না। আল্লাহর কালাম বলেই তারা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের অপূর্ব সৌন্দর্য সবাইকে ছুঁয়ে গেলেও এর বার্তা ও শিক্ষার হাতছানি কেন সবাইকে স্পর্শ করেনি? কুরআনের সত্যাসত্যির ব্যাপারে এতটা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা থাকার পরও কেন কুরআনকে দিল থেকে কবুল করে নিতে পারেনি তারা?
এর উত্তর খোদ কুরআনই দিয়ে রেখেছে। অহংকার, হঠকারিতা, জেদ, জাত্যভিমান, প্রতিশোধপ্রবণ মনোভাব, ভোগবাদি মানসিকতা, অন্যায় বাদানুবাদ ইত্যাদি জাহেলী বৈশিষ্ট্যগুলোই তাদের জন্য কুরআনের আলো গ্রহণে বড় বাধা হয়েছিল।
উন্মুক্ত হৃদয়ে কুরআনের কাছে এলেই কুরআন তাকে ঢেকে নেয় হেদায়েতের চাদরে।
আল্লাহ তাআলা বলেন―নিঃসন্দেহে এতে উপদেশ রয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য, যার আছে (উন্মুক্ত) হৃদয় কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে। ―সূরা ক্বাফ (৫০) : ৩৭