এক সময় বাহন বলতে বোঝানো হত উট, ঘোড়া, গাধা বা খচ্চর জাতীয় পশু। যেগুলো তৈরিতে মানুষের কোনো ভূমিকা থাকে না। বরং আল্লাহ তায়ালাই মানুষের চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী এসব পশুকে মানুষের আয়ত্তাধীন করে দেন।
হাতি-ঘোড়ার মতো বড় বড় জন্তু-জানোয়ারকে মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন বানিয়ে দেন। আল্লাহ তায়ালার এই অপার দয়া ও অনুগ্রহ আছে বলেই একটা ছোট বাচ্চাও উটের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। যেখানে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা চালিত করতে পারে।
উট-ঘোড়ার সেসব বাহন এখন আর নেই বললেই চলে। বর্তমানের যানবাহন অনেক বদলে গেছে। প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষ দিন দিন মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে উন্নত থেকে উন্নততর স্থলযান, নৌযান ও আকাশযান।
এসব যানবাহনের কলকবজা নেড়ে চালিত করে মানুষ ভাবতে থাকে, এগুলো তো আমরাই তৈরি করেছি, আমাদের হাতেই এগুলো চালিত হচ্ছে; এগুলোর নিয়ন্ত্রণও আমাদের হাতেই! কিন্তু পত্র-পত্রিকার দৈনন্দিন সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমাদের এই যান্ত্রিক ধারণাকে পাল্টে দেয়।
আমরা অনেকে অ্যাকসিডেন্টকে অস্বাভাবিক ঘটনা মনে করি। আসলে বাস্তবতা হল, এত বড় বড় যানবাহন আমাদের মতো ছোট ছোট মানুষের হাত ধরে চালিত হওয়াই বরং অস্বাভাবিক ঘটনা। আল্লাহ তাআলাই এসব যন্ত্রগুলোকে মানুষের ব্যবহার-উপযোগী করে দিয়েছেন। যখন তখন বিগড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করছেন।
তাছাড়া এসব যানবাহনের কাঁচামাল তো সরাসরি আল্লাহ তাআলারই দেওয়া। এবং আল্লাহর দেওয়া ক্ষমতা ও যোগ্যতার বলেই মানুষ এগুলো তৈরি করছে।
তাই যখনই আমরা কোনো যানবাহনে আরোহণ করি, আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত। নিজেদের দীনতা ও অক্ষমতার কথা স্বীকার করে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা উচিৎ।
পাশাপাশি এ কথাও স্মরণ রাখা দরকার যে, যানবাহনের সফর আমাদের জন্য সাময়িক সময়ের সফর মাত্র। একসময় আমাদের সবাইকেই আখেরাতের সফরে রওয়ানা হতে হবে। আল্লাহ তাআলার দরবারে ফিরে যেতে হবে।
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত, অর্থ ও ফজিলত
কুরআন কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
وَ الَّذِیْ خَلَقَ الْاَزْوَاجَ كُلَّهَا وَ جَعَلَ لَكُمْ مِّنَ الْفُلْكِ وَ الْاَنْعَامِ مَا تَرْكَبُوْنَ، لِتَسْتَوٗا عَلٰی ظُهُوْرِهٖ ثُمَّ تَذْكُرُوْا نِعْمَةَ رَبِّكُمْ اِذَا اسْتَوَیْتُمْ عَلَیْهِ وَ تَقُوْلُوْا سُبْحٰنَ الَّذِیْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَ مَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنِیْنَ وَ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ.
সেই সত্তা, যিনি সর্বপ্রকার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য নৌযান ও চতুষ্পদ জন্তুর বাহন তৈরি করে দিয়েছেন। যাতে তোমরা তার পিঠে আরোহণ করতে পার। অতঃপর যখন তোমরা তাতে চড়ে বস, তখন তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর এবং বল-
سُبْحٰنَ الَّذِیْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَ مَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنِیْنَ وَ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ.
উচ্চারণ: সুবহানাল্লাজি সাখখারা লানা হাজা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনিন ওয়া ইন্না ইলা রব্বিনা লামুনকলিবুন
অর্থ: পবিত্র সেই সত্তা, যিনি এই বাহনকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন। অন্যথায় একে বশীভূত করার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। আর আমাদেরকে তো আমাদের প্রতিপালকের কাছেই ফিরে যেতে হবে। -সুরা যুখরুফ (৪৩) : ১২-১৪
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) সফরের উদ্দেশে বের হয়ে সওয়ারির ওপর পা রেখে তিনবার তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলতেন। তারপর এই দোয়া পড়তেন। সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৪২
সফরে রাসুল (সা.) আরেকটি দোয়া পড়তেন
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِي سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى اللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ وَالْخَلِيفَةُ فِي الأَهْلِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوءِ الْمُنْقَلَبِ فِي الْمَالِ وَالأَهْلِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফরিনা হা-জাল বিররা ওয়াত তাকওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা তার-দা আল্লাহুম্মা হাউয়িন আলাইনা সাফারনা হা-যা, ওয়াতওই আন্না বু’দাহু, আল্লাহুম্মা আনতাস্-সাহিবু ফিস্-সাফার, ওয়াল খালিফাতু ফিল আহলি ওয়াল মাল। আল্লাহুম্মা ইন্না নাউজুবিকা মিন ওয়া-ছা-ইস সাফারি ওয়া-কাআবাতিল মানজারি, ওয়া সুইল মুনকালাবি ফিল আহলি ওয়াল মাল।’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের এ সফর সহজ করে দাও। রাস্তার দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সফরের সঙ্গী এবং আমাদের পরিবারের কাছে তুমি আমাদের স্থলাভিষিক্ত। হে আল্লাহ! তোমার কাছে সফরের কষ্ট-ক্লান্তি ও ভয়ানক দৃশ্য দেখা থেকে এবং পরিবার, সম্পদ-বিত্ত ও অধীনস্তদের কাছে খারাপ অবস্থায় ফেরত আসা থেকে তোমার কাছে রক্ষা চাই। (মুসলিম, হাদিস : ৯৭৮/২)
নৌকা বা জাহাজে ভ্রমণের দোয়া
بِسْمِ اللَّهِ مَجْرَاهَا وَمُرْسَاهَا إِنَّ رَبِّي لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি মাজরিহা ওয়া মুরসা-হা, ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রহিম।
অর্থ: তোমরা এতে আরোহন কর। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। আমার পালনকর্তা অতি ক্ষমাপরায়ন, মেহেরবান। (সুরা হুদ :৪১)