Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

কে যাবি বেহেশতে, আয়

Icon

মোহাম্মদ নূরল হক

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪, ০২:৫২ পিএম

কে যাবি বেহেশতে, আয়

বিদায় নগণ্য, এলেম কালামে আরও কম, বলতে পারেন যৎকিঞ্চিত । তাই অনেক আলোচনায় আমায় থাকতে হয়, থাকি, কিন্তু দর্শক হিসেবে। আলোচনা-সমালোচনায় আমার ভূমিকা নীরব । আমার এ অবস্থানের  সুযোগ বুঝে কেউ কেউ খোঁচা মারেন, যেন খোঁচার খোটায় মুখ ফোটে । কতক্ষণ আর চুপ থাকা যায়, তাই যুক্তি হিসেবে বলি— দীর্ঘদিন বিচার বিভাগে জজিয়তি পেশায় থাকায় শোনার অভ্যাস বেড়েছে, কথা কম বলাতে স্বস্তিবোধ করি । তবুও শুনতে হয় । 

উনি দানশীল । রহিম সাহেব দয়ার আঁধার । মোহন বাবু  দিল দরিয়া কারও কষ্ট সইতে পারে না । সাহায্য করার জন্য  ঝাঁপিয়ে পড়ে । আলহাজ¦ সুজন মিয়া একাধিকবার বড় হজ¦ করেছেন এবং সুযোগ পেলেই ছোট হজ¦-ওমরা করতে ছুটে যান মক্কায় । হজরত মাওলানা চাঁদপুরী অনেক মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। মুফতি মোহাম্মদ রেজা হুজুর হাদিস কুরআনে ডাল বরাবর।  হুগলির শেখ সাহেব যেখানেই জনদুর্ভোগ, সেখানেই হাজির, অর্থাৎ জনদরদি । মহামহিম মাদার তেরেসা আজীবন করেছেন মানবের সেবা । অন্য আরও অনেকেই আছেন তাদের কেউ কেউ দাবি করেন তার দেল-মন পরিষ্কার ফকফকা । 

কদিন আগে এক বন্ধুর বাসায় তার বিদেশফেরত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পাপিয়া ভাবির সাথে কথা হচ্ছিল । তিনি বোরকা নিয়ে প্রসঙ্গ তুলে প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে বলছিলেন যে, মুসলিম মহিলার প্রতি এটা একটা জবরদস্তি, স্বাধীনতা হরন। এটা কি সহ্য করা যায়। তার স্বামী দেবতা আমার মুখমণ্ডলে চক্ষু বিস্ফোরিত আলো প্রক্ষেপণ করলেন । দেখে অবাক হলো যে, আমি নিরুত্তর । অবশ্য বলে রাখা ভালো পর্দার প্রসঙ্গটি ভাবিই উত্থাপন করেন আমার জ্ঞানগর্ভ জবাব প্রত্যাশা ছিল লক্ষ্য।

বললাম ভাবি বোরকা পর্দার একটি অংশমাত্র । পর্দার অর্থ আমার আপনার ধর্ম ইসলামে ব্যাপক এবং বিস্তৃত। শুধু নারী নয়, ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়েই পর্দার আওতাভুক্ত । যেমন পুরুষের চলা ফেরায় দৃষ্টি থাকবে সংযত, লোলুপ নয় । কথাবার্তায় ইত্যাদিতে নারী-পুরুষের পর্দা অভিন্ন । বেফাস বা ফায়েসা কথা পর্দা বিবর্জিত । ভাবি দ্বিমত পোষণ করে বললেন— সব কিছু দিলের ভেতর, অন্তরে নিবদ্ধ । দেল ভালো তো জগৎ ভালো । শুনে আমাকেই বলতেই হলো, তা হলে ন্যুড ড্যান্স বা ন্যুড পার্কে যাওয়া বা অবস্থান করা কি পরিষ্কার দিলের বহিঃপ্রকাশ ।

ভাবলাম এসব কথায় দাঁড়ি টানা উচিত । কিন্তু যাদের কথা এতক্ষণ বলা হলো, তাদে দাবি তারা মৌলবাদী নন; বরং প্রগতিশীল । ভাবে প্রকাশ, ইহকালে তারা শান্তির দূত এবং পরকালে তাদের জন্য স্বর্গে দ্বার উন্মুক্ত । শুধু প্রবেশের অপেক্ষা । 

স্বর্গ । ইহা পরকালের সাথে সম্পৃক্ত । পরজগতের আবাসস্থল । কে যাবে বা পাবে স্বর্গের টিকিট এ সম্পর্কে ধর্মীয় গ্রন্থ আল কুরআনের বহু জায়গায় বহুভাবে পরিষ্কার করে বলা আছে । সহজ ভাষায় বলতে গেলে ইহা শুধু মানুষের জন্য । 

মানুষ শব্দটি একবচন হলেও মানুষ বলতে সমস্ত মানুষকে বোঝায় । নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, আমির-ফকির, সর্ব বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠী নির্বিশেষে স্বর্গপ্রাপ্তির ধারণা আছে এবং দাবি করা হয় । অবশ্য নাস্তিক ব্যতীত,  স্বর্গ-নরকে তাদের কোনো আগ্রহ নেই । যাই হোক, ইসলাম ধর্ম মতে যে বিধানাবলি বা স্বর্গপ্রাপ্তির যে শর্তসমূহ বিধৃত আছে তার সারমর্ম এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রাসঙ্গিক বিধায় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইসলামিক বিধিবিধানের মূল উৎস কুরআন । এর পরে আছে হাদিস, ইজমা, কিয়াস ইত্যাদি ।


আল কুরআনের ১০৩নং সুরা আসরের ৩নং আয়াতে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া বা বেহেশতে যাওয়ার জন্য চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে মর্মে উল্লেখ আছে, তা হলো— (১) ইমান, (২) নেক আমল (৩) সত্যের পথে ডাকা বা থাকা এবং (৪) ধৈর্যশীল হওয়া বা ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেওয়া ।

উল্লিখিত শর্তসমূহ যথাযথভাবে অর্জন ও প্রতিপালন করলে মানুষ দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পাবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে অর্থাৎ স্বর্গপ্রাপ্তির পথ সুগম হবে ।

আরও পড়ুন: ছয় কাজের বিনিময়ে জান্নাতের গ্যারান্টি দিয়েছেন নবীজি

বর্ণিত শর্তাবলি সম্পর্কে যতটুকু সংক্ষেপে সম্ভব আলোচনা করলে বিষয়টি অনেকের কাছে সহজ ও বোধগম্য হবে সন্দেহ নাই ।

১. ইমান: যে চারটি শর্ত বা গুণাবলি অর্জন  করলে মানুষ ক্ষতিমুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে, তন্মধ্যে প্রথম গুণটি হলো — ইমান । এই শব্দটির অর্থ হচ্ছে স্বীকৃতি দেওয়া । আর শরিয়তের পরিভাষায় ইমানের অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কাজকর্মে বাস্তবায়ন ।

এখন প্রশ্ন হলো ইমান আনা বলতে কীসের ওপর ইমান আনা বুঝায়। কুরআন মজিদে এর জবাবে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে—

ক. প্রথমত এক আল্লাহকে স্বীকার এবং মানা। কিন্তু নিছক তার অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া নয়; বরং তাকে এমনভাবে মানতে হবে, যাতে বুঝা যায় তিনি একমাত্র প্রভু ও ইলাহ । তার সর্বময় কর্তৃত্বে কোনো অংশীদার নেই । তিনি একমাত্র হুকুমদাতা ও নিষেধকর্তা । তিনি সবকিছু দেখেন ও শোনেন । 

খ. দ্বিতীয়ত রাসুলকে মানা। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবী, আল্লাহর নিযুক্ত পথপ্রদর্শক এবং নেতৃত্বদানকারী হিসেবে মানা । তিনি যা শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দিয়েছেন, সবই সত্য এবং অবশ্যই পালনীয় বলে মেনে নেওয়া । সাথে সাথে এটার স্বীকৃতি দেওয়া যে আল্লাহপাক  যুগে যুগে অনেক রাসুল ও নবী পাঠিয়েছেন, তন্মধ্যে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী ও রাসুল । তার পরে আর কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না ।

গ. তৃতীয়ত ফেরেস্তাদের ওপর ইমান ।

ঘ. চতুর্থত আল্লাহর কিতাবসমূহের ওপর ইমান। বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের ওপর ইমান প্রতিষ্ঠা করা এবং এই কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নে সদা সচেষ্ট থাকা ।

ঙ. পঞ্চমত  আখেরাতকে বিশ্বাস করা । মৃত্যুর পর মানুষকে জীবিত করা হবে এবং দুনিয়ার কৃতকর্মের জন্য বিচার শেষে পুরস্কার হিসেবে বেহেশত এবং আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘনের  জন্য নরক বাস নিশ্চিত করা হবে। এসব কিছুতেই দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে ।

২.নেক আমল:  ইমানের পর মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি থাকা দরকার, সেটি হচ্ছে সৎকাজ। কুরআনের পরিভাষায় একে বলা হয় আমাল সালেহা । সমস্ত  সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে যে কাজের মূলে ইমান নেই এবং যা আল্লাহ ও রাসুল প্রদও হেদায়েতের ভিত্তিতে সম্পাদিত নয়, তা কখনো সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না ।

৩. সত্যের পথে ডাকা বা থাকার উপদেশ দেওয়া:
       
প্রত্যেক মানুষ, একে অপরকে আল্লাহতাআলার শরিয়তের অনুগত করা, নিষিদ্ধ বস্তু ও পাপাচার থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেওয়া ।
  
৪.  ধৈর্য  ধারণের উপদেশ: 

ধৈর্য বা সবর শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাধা দেওয়া বা আটকানো । এখানে কয়েকটি অর্থ হতে পারে । এক. যাবতীয় গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা । দুই. সৎকাজ করা এবং এর ওপর দৃঢ় থাকা । তিন. বিপথ-আপদে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা । এসবই সবরের শামিল। অর্থাৎ  দুঃখ-কষ্ট, মসিবতে ও ইসলামি বিধিবিধান ও ফরজসমূহ পালন করতে ধৈর্য ধারণ করা এবং কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেওয়া ।

অতএব হে মানুষ, অনুধাবন করার সময় এসেছে কুরআনের ১০৩নং সুরা আসর এবং ৩নং আয়াতে প্রদও ৪টি শর্ত বোঝার ও মানার । প্রথমটি বাদ দিয়ে অপর তিনটি পূরণ করল কিনা— ইমান নেই, শেষ বিচারে এমন কেউ উত্তীর্ণ হতে পারবে ইহা কল্পনাতীত । একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । একজন ছাত্র পাশ করার জন্য পরীক্ষায়  চারটি বিষয় যথা— বাংলা, ইংরেজি, অংক ও সমাজবিজ্ঞানে অংশগ্রহণ করল । অংক বাদে অবশিষ্ট তিন বিষযে ৯৯ শতাংশ নম্বর পেল; কিন্তু অংকে পেল ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১০ নম্বর । তা হলে কি সেই ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলে ঘোষণা বা গণ্য করা হবে? উত্তর অবশ্যই না । সুতরাং  বলতে দ্বিধার কোনো অবকাশ নাই যে আলোচ্য ৪টি শর্তের প্রতিটি অবশ্য পালনীয়, অন্যথায় অকৃতকার্য মর্মে ক্ষতির হাত থেকে নিস্তার নেই । স্বর্গ লাভ সম্ভব হবে না । সুতরাং অহেতুক বিতর্ক নয় বরং কথিত মতে, সমঝদার কা লিয়ে ইশারায় কাফি ।

লেখক: মোহাম্মদ নূরল হক
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব.)
বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ
শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম