জবানের হেফাজত জান্নাতের সুসংবাদ দেয়
হাসানুল বান্না অলি
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:০৩ পিএম
ইসলাম নিছক একটি ধর্ম নয় বরং একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে নামাজ রোজা,হজ,জাকাতসহ দৈহিক ইবাদতের নির্দেশনার পাশাপাশি মানব চরিত্রের উন্নতি সাধনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর সাথে সাথে মানব জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটি বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া আছে।
ইসলামের এই বিধিবিধান গুলো মানবজীবনকে সুন্দর ও পরিমার্জিত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসলামের নির্দেশনা গুলো সর্বযুগীয় ও চির আধুনিক। স্থান-কালের বিবর্তন তাকে ফ্যাকাশে করতে পারে না। বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে যুগ-যুগান্তরে নির্দেশনাগুলো চিরনতুন থেকে যায়
চরিত্র উন্নতির স্বর্ণশিখরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে শরীরের যতগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভূমিকা আছে তার মধ্যে অন্য হলো জবান বা মুখ। এই জবানের একটি মাত্র বাক্য মানুষকে ইমানের রাস্তা দেখিয়ে দেয় আবার ইমানের আলো থেকে কুফরির অমানিশার ঘোর কালোতেও ফেলে দিতে পারে।
এই জবানই একজন অপরিচিত, অচেনা মানুষকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে দিতে পারে আবার নিজেদের সাজানো সংসার, দাম্পত্য জীবনের সুখের বাগানকে নিমিষেই তছনছ করে দিতে পারে। এই জবানের একটি কথাই চির শত্রুকে পরম বন্ধু আর কলিজার বন্ধুকে চিরশত্রুতে রুপান্তরিত করে দেয় নিমিষেই।
এই জবানই মানব জীবনের সম্মান বয়ে আনার বাহক আবার জীবনের কুড়ানো সকল সম্মানকে একটি কথার দ্বারাই শেষ করে দিতে অগ্রসর ভূমিকায় থাকে। মোট কথা হলো, জীবনে চলার পথে জবানের ভূমিকা যারপরনাই বেশি।
একজন উত্তম মুসলিমের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার হাত ও জবান (মুখ) থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে তিনিই হলেন প্রকৃত মুসলিম। (বুখারি-০৯)।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়- আমরা হরহামেশাই এই জিহবার অপব্যবহার করছি। মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো গীবত-কুৎসা,বদনাম ও তাচ্ছিল্য করে যাচ্ছি। বাস্তবে তো করিই তার সাথে সাথে ভার্চুয়াল জগতেও আমরা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে যা মন চায় তাই বলে দিচ্ছি।
খারাপ লাগাটা তখনই বেড়ে যায় যখন দেখি কোনো আলিম অপর কোনো আলিমের বিপক্ষে তার জবান ব্যবহার করে। এই কাজগুলো করার আগে বিন্দু পরিমাণ ভয় তো দূরের করা একটু মনের মধ্যে একটু সতর্কতা কাজ করে না।
অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই। প্রত্যেক মুসলিমের সম্মান, রক্ত ও সম্পদ অন্য মুসলিমের জন্য হারাম। কিন্তু আমাদেরকে দেখলে মনে হয় হাদিস কেবল গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ আছে আর আমাদের পাঠের মাধ্যমেই এর হক আদায় হয়ে যাবে। বাস্তব জীবনে এর কানাকড়ি মূল্যও নেই।
প্রতিটি দ্বীনদার মুসলিমের জন্য তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে জিহবা তথা তার জবান বা মুখের ব্যবহারকে সংযত করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আমার জন্য দুই চোয়াল আর দুই রানের মধ্যবর্তী (জিহবা ও লজ্জা স্থানের) হেফাজতের দায়িত্ব নিবে,আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব নেবো। (বুখারি-৬৪৭৪)
মুসলিম শুধুমাত্র কল্যাণ আছে এমন বিষয়েই কথা বলবে। এমনকি কল্যাণ লাভের বিচারে যদি কথা বলা বা না বলা সমান হয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে চুপ থাকা সুন্নাত। কারণ স্বাভাবিক কথাবার্তাও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর হাজারো চেষ্টা করে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায় না।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ইমান এনেছে, সে যেন উত্তম বা ভালো কথা বলে বা চুপ থাকে। (মুসলিম-৪৭)।
জিহবা বা জবান কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটা বর্ণনা করে বুঝানো অসম্ভব। জিহবা মানব জীবনের গতিপথকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে। আমাদের সালফে সালেহীনরা জিহবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন।
একদিন হজরত ওমর (রা.) দেখলেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নিজেই নিজের জিহবা বের করে হাত দিয়ে টেনে ধরেছেন। ওমরা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে খলিফাতুল মুসলিমিন, আপনি কি করছেন? জবাবে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, 'এটাই আমাকে ধ্বংসের স্থানে নিক্ষেপ করেছে'।
হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, মানুষ যখন সকাল বেলা ঘুম থেকে জাগ্রত হয় তখন তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একসাথে জিহবাকে মিনতি করে বলে,তুমি আমাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। তুমি ঠিক থাকলে আমরা ঠিক থাকবো আর তুমি বেঁকে গেলে আমরাও বেঁকে যাবো। (তিরমিজি-২৪০৭)
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, মানুষ যখন কথা বলতে চায়, তখন তার উচিৎ কথা বলার আগে ভেবে নেওয়া। কল্যাণ আছে একদম শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবে না।
ইমাম নববী রহ. বলেছেন, কোনো মুসলিমের জন্য এমন কথা বলা বলা সমীচীন নয়; যাতে কোনো উপকার বা কল্যাণ নেই। কোনো মুসলিম সন্দিহান বিষয়েও কথা বলবে না বরং শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তারপর কথা বলবে।
একজন ইসলামী পন্ডিত বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে আট হাজারেরও বেশি দোষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে একটি জিনিস আমি খুঁজে পেয়েছি যেটার আমল করলে তার সব দোষ গোপন থাকবে আর সেটি হলো জবান বা মুখের হেফাজত।
কিছু কিছু আলিম জিহবাকে হিংস্র প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন। তারা বলেছেন, জিহবাকে বেঁধে রাখো নতুবা সে তোমাকেই আক্রমণ করবে। এই জিহবা বা জবান বীর পালোয়ানকেও পরাস্ত করে দাবিয়ে দিতে পারে এক মুহুর্তেই।
ব্যক্তিত্ব গঠনে জবানের হেফাজতের বিকল্প কিচ্ছু নেই। সুতরাং মানুষের সৌন্দর্যই হলো তারা জিহবাকে সংযত করবে এবং অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় সকল কথাবার্তা সম্পূর্ণরুপে পরিহার করবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, দা'ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।