পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী। আমরাও ক্ষণস্থায়ী। সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক সবই আল্লাহর সৃষ্টি। সবাই আল্লাহর আল্লাহর বান্দা।
এই পার্থিব জীবন সবার জন্যই পরীক্ষাস্বরূপ। আমরা যা করব তার হিসাব আমাদের দিতে হবে। তাই সমাজের কাউকে তুচ্ছ ভাবা আদৌ উচিত নয়। কাউকে ছোট মনে করে তার সঙ্গে দূর ব্যবহার করা কখনো সমীচীন নয়।
নিজেকে শক্তিশালী মনে করে অধীনস্থের প্রতি বেপরোয়া আচরণ করা ভদ্র মানুষের কাজ নয়। গত দুদিন আগে আমি আমার ছোট বাবুকে নিয়ে মগবাজার আদ্ব-দিন হাসপাতালে যাই। চিকিৎসা শেষে এক রিকশায় করে বাসায় ফিরে আসি।
রিকশাওয়ালাকে দেখে মনে হলো তিনি আজ খুবই ভারাক্রান্ত। তার চেহারাটা মলিন এবং সে ফ্যাকাসে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে এতটা বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন? মুহূর্তেই তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
তিনি বললেন, আজ আমি দোকানদারের চপেটাঘাত খেয়ে খুবই মর্মাহত। আমার এক ছোট দুধের বাচ্চা রয়েছে। তার বয়স দুই মাস। মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার আমাকে লেকটোজেন খাওয়াতে বলে। আমি এক বাসার সিকিউরিটি গার্ড ছিলাম। আমার দিনকাল মোটামুটি ভালোই চলছিল। হঠাৎ চাকরিটা চলে গেল। কোন উপায় পেয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী ফোন দিল। বাচ্চাটা কান্না করছে দুধ নেই। আমার কাছে তিনশ টাকা ছিল তাই নিয়ে আমি দোকানে গেলাম। যে দোকান থেকে আমি বাকিতে কেনাকাটা করতাম মাস শেষে বেতন পেয়ে তা পরিশোধ করে দিতাম। আমার যে এখন চাকরি নেই দোকানদারের তা জানা ছিল।
আমি দোকানদারকে তিনশ টাকা দিয়ে বললাম ভাই আমাকে একটা লেকটোজেন দেন। বাকি টাকা আমি সন্ধ্যায় পরিশোধ করে দেব ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সে রাজি হলো না। যেহেতু সে আমার পরিচিত ছিল, তাই আমি কৌটাটা হাতে নিয়ে নিলাম। অনেকটাই আবদারের ভঙ্গিতে। কিন্তু এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার মুখে সজোরে আঘাত করে। পরে আমার ঠোঁট দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে।এবং জঘন্য ভাষায় আমাকে গালি দিল। আমি চলে আসলাম।
এর মধ্যেই বাসা থেকে ফোন এলো, বাসায় চাল নেই অল্প কিছু যা আছে তা একজন কোনোমতে খেতে পারবে। আমি বললাম আমার মাকে খাইয়ে দাও আমরা না হয় উপবাস থাকব। তার পর আবার দুধের কথা বললে আমি ফোন লাইন কেটে দিই।
রিকশাওয়ালা আমাকে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল। আর তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছিল। হৃদয়বিদারক এ বিবরণ শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। চিন্তা করতে লাগলাম মানুষের ভেতর মানবতাই যদি না থাকে, তা হলে তো সে মানুষ নয়; বরং মানুষরূপী পশু।
দোকানদার তাকে একটু সময়ের জন্য বাকি দিলে তার কী ক্ষতি হয়ে যেত। কিন্তু তার প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছে আর এই অসহায় মানুষটির দিল থেকে আহ বেরিয়ে পড়েছে এর ফল কী দাঁড়াবে? তার দিলের আহাজারি কি আরশে আজিমে পৌঁছবে না? ধনী-গরিব তো আল্লাহই বানিয়েছেন?
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থাকো। কারণ মজলুমের বদদোয়া কবুল হওয়ার মাঝে কোন আড়াল থাকে না। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং ২৪৪৮)
এগুলো ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে গেলাম। আমার হাতেও তখন পর্যাপ্ত টাকা ছিল না, তবু তাকে ভাড়ার চেয়ে একটু বেশি দিলাম। এতেই সে অনেক খুশি প্রকাশ করল।
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, শেখ জনূরুদ্দীন (র.) দারুল কুরআন মাদ্রাসা, চৌধুরীপাড়া, ঢাকা।