ধর্ম উপদেষ্টার মুখোমুখি
শান্তি ও সমৃদ্ধির ফুল ফুটুক ধর্মের আঙিনায়
তানজিল আমির ও মুহসিন আল জাবির
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শান্তি ও সমৃদ্ধির ফুল ফুটুক ধর্মের আঙিনায়
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন ড. মাওলানা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম আলেম উপদেষ্টা। আ ফ ম খালিদ হোসেন ইসলামি অঙ্গনে তুমুল জনপ্রিয়। কওমি, আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় দেশে প্রচলিত শিক্ষার তিন ধারাতেই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আ ফ ম খালিদ হোসেন শিক্ষা, গবেষণা ও ধর্মীয় বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে দেশের ইসলামি ঘরানার প্রায় সবার সমর্থন পেয়েছেন তিনি। হজ-ওমরাহর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংস্কারসহ ধর্ম মন্ত্রণালয় সব কাজে আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন আ ফ ম খালিদ হোসেন। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানজিল আমির ও মুহসিন আল জাবির।
* যুগান্তর : অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আপনি সরকারের অংশ হয়েছেন। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : এই দায়িত্বটা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো লবিং বা তদবির ছিল না। এটি একমাত্র আল্লাহতায়ালার দয়া। দেশের বিভিন্ন ইসলামি দল এবং সামাজিক সংগঠন আমার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছে। এ জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। আমি আশা করি যে, সততা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাব ইনশাআল্লাহ।
* গত এক যুগেরও অধিক সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের কাজ বলতে গেলে থমকেই আছে, সে বিষয়ে আপনি কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : আমরা ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ঢেলে সাজাতে চাই। আমাদের কিছু সমস্যা আছে, যেমন আমাদের পরিচালক কম। নতুন যে ডিজি আসবেন তিনি আমার পরামর্শক্রমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যেই বিভাগগুলো আছে, সেগুলো ঢেলে সাজাবেন। ফাউন্ডেশনের অধীনে যত বিভাগ আছে সেগুলোর অচলাবস্থার নিরসন ঘটিয়ে আমরা এটিকে একটি প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চাই।
* ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে ইমাম প্রশিক্ষণের একটি প্রকল্প রয়েছে, কিন্তু দেশের বেশির ভাগ ইমাম এটির সঙ্গে যুক্ত নন।
আ ফ ম খালিদ হোসেন : ইমাম প্রশিক্ষণ বিভাগেও নতুন পরিচালক নিয়োগ করা হবে। এ প্রশিক্ষণকে কীভাবে আরও ভ্যালিউবল ও জনবান্ধব করা যায় সেটির পরামর্শও সবার থেকে নেব।
* চাঁদ দেখা নিয়ে প্রতিবছরই আলোচনা-সমালোচনা হয়, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই
আ ফ ম খালিদ হোসেন : আমরা চাঁদ দেখা কমিটিকেও পুনর্বিন্যাস করতে চাই। ঈদ এবং অন্যান্য ইসলামি যেই দিবসগুলো আছে, সেগুলো চাঁদ দেখার মাধ্যমেই শুরু হয়। এ কমিটিতে আরও স্কলার আমরা নিয়োগ করব। বিজ্ঞ মুফতিদের সহযোগিতায় আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে আকাশের গতিবিধি নিরূপণ করতে পারে এমনভাবে চাঁদ দেখা কমিটিকে সাজাব।
* বাংলাদেশে তিন লাখের বেশি মসজিদ রয়েছে। যেখানে জুমাসহ বিভিন্ন সময় মুসল্লিরা একত্রিত হয়ে থাকেন। দেশের মসজিদগুলো নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : দেশের সব মসজিদ আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। চট্টগ্রামে দুটি, ঢাকা ও রাজশাহীতে একটি করে মসজিদ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এ চারটি মসজিদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া মডেল মসজিদগুলো আমরা পরিচালনা করে থাকি। জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি আছে। তো এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের মাধ্যমে চলে। এসব মসজিদের খুতবা যেন একটু ইউনিক হয় তার জন্য আমাদের নির্দেশনা আছে। তবে অন্য মসজিদগুলোকে আমরা অনুরোধ করতে পারি-কিন্তু আদেশ দিতে পারি না। এরপরও এ মসজিদগুলোকে ব্যবহার করে খুতবার মধ্যে সমাজবান্ধব বিভিন্ন ইস্যু আলোচনা করে জনগণকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করার প্রয়াস আমাদের ছিল এবং আগামীতেও থাকবে।
* জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পরিবেশ নিয়ে মুসল্লিরা অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন। দেশের জাতীয় মসজিদ হিসাবে এটি তেমন সংস্কার হয়নি। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : বায়তুল মোকাররম মসজিদের নিচে ও আশপাশে বিশাল মার্কেট রয়েছে। যার কারণে মসজিদের ভাবগাম্ভীর্য অনেকটা কমে গেছে। পরিবেশবান্ধব বিশাল ফুলের বাগান এসব বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণের সময় স্থাপন করা উচিত ছিল। এখন তো আর এসব করার সুযোগ ও জায়গা নেই। তবে দ্রুতই আমরা বায়তুল মোকাররম মসজিদকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা খরচ করে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করব।
মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে কীভাবে আরও সৌন্দর্য বর্ধন করা যায়, সেটি করা হবে। যাতে করে মসজিদের পবিত্রতা অনুভব হয়। বায়তুল মোকাররমে প্রবেশ করলেই যেন মানুষের মন ইবাদতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এমন একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি এবং এটা বাস্তবায়ন করা হবে ইনশাআল্লাহ।
* হজ-ওমরাহর খরচ কমানোর বিষয়ে কী ভাবছেন?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : হজ-ওমরাহর খরচ কমাতে এবং এ সেক্টর দুর্নীতিমুক্ত করতে আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করছি। আমরা হজের জন্য দুটি প্যাকেজের চিন্তা করছি। একটা কাবার খুব কাছেই যেটা আগে থেকেই চলে আসছে। আরেকটা একটু দূরে হবে যেখান থেকে বাস মিসফালা ব্রিজের কাছে নামিয়ে দেবে। প্রথম প্যাকেজ থেকে বিমান ও ঘরভাড়ার দিক দিয়ে কমাব। এখানে একটা কথা হচ্ছে, সৌদি সরকারকে আমাদের একটা বিশাল চার্জ দিতে হয়, যা অনেকেই জানে না। মনে হয় যে বিমান ভাড়া এত টাকা নেয় কেন? মূলত হজের সফরে তিন জায়গায় টাকা দিতে হয়। সৌদি সরকারকে আমাদের নির্ধারিত টাকা দিতে হয়। যার বিপরীতে মিনা, মুজদালিফা, আরাফায় তারা সবকিছুর ব্যবস্থা করেন। এসবের বিল কিন্তু আমাদেরই দেওয়া লাগে। সেখানে এ, বি, সি, ডি এভাবে জোন ভাগ করা থাকে, সেটার ভাড়া তারাই ঠিক করে।
এরপর ঘরভাড়া কমানোর চেষ্টা করব। বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমরা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে বিমানের ভাড়া কতটুকু কমাতে পারি তা ঠিক করব। এনবিআরকে হাজিদের মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এখন এনবিআরের সঙ্গে কথা বলে যদি এই টাকা মওকুফ করতে পারি তাহলে ৫ হাজার টাকাও কমে গেল। এছাড়া ৩৫ হাজার টাকা আমরা প্রতিজন হাজি থেকে নিয়ে আবার সেটি আশকোনায় ফেরত দেই। এটি নেওয়ার দরকার কী আবার ফেরত দেওয়ারই দরকার কী! এগুলো কমাতে পারলে ৪০ হাজার তো এখানেই কমে গেল। বিমান ও ঘরভাড়া যদি আরও কমাতে পারি তাহলে আশা করা যায় দুটি প্যাকেজেই কমিয়ে ফেলতে পারব ইনশাআল্লাহ।
* সরকারি খরচে হজে পাঠানোর একটি রীতি চলে আসছে, রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে হজে পাঠানো কতটা যৌক্তিক?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : এ বিষয়ে সবার ভুল ধারণা আছে যে হাজিদের থেকে টাকা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের লোকরা হজ করে আসে। আমি আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, হাজিদের থেকে এক পয়সাও মন্ত্রণালয় নেয় না।
হাজিদের চিকিৎসা, দাফন-কাফনসহ নানা কাজে আমাদের লোকবল লাগে। তাই মন্ত্রণালয় থেকে বিশাল একদল নিতে হয়। হজ নিয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবসা করে না বরং সেবা দেয়। মানুষের ধারণা হাজিদের টাকা নিয়ে আমরা হজ করি, আসলে এটা ভুল ধারণা। এটা মন্ত্রণালয়ের টাকা। টাকা যেহেতু সরকারের তো সরকার চাইলেই মানুষের সংখ্যা কমাতে পারেন আবার বাড়াতে পারে।
* সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় মাজার ভাঙতে দেখা গেছে। এর মাধ্যমে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে না?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : মাজার ভাঙার একটি প্রবণতা শুরু হয়েছে। মন্দিরে হামলা, মাজারে হামলা এবং মিছিলে হামলা এগুলো একই সূত্রে গাঁথা। একটা বিশেষ গ্রুপ এগুলো করছে। আমরা ডিসিদের মাধ্যমে তথ্য নিচ্ছি যে কোথায় কোথায় আক্রমণ হয়েছে। এখন মাজার ভাঙার জন্য কিছু মানুষ উঠেপড়ে লেগেছে। আপনি তো আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না। বিচারের দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। কার্যকর করবে প্রশাসন। যেসব মাজারে শিরক হয়, জুয়া খেলে মাদকের ব্যবহার হয় এসব আমাদের জানান, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমি আশাবাদী এগুলো কমে আসবে।
* আমরা জানি আপনি আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন, এটি সম্পর্কে একটু জানাবেন?
আ ফ ম খালিদ হোসেন : চট্টগ্রামের নানুপুর মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালক মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরীর হাতে আমি প্রথম বাইয়াত হই। তার ইন্তেকালের পর আল্লামা শাহ আহমদ শফির সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করি। এছাড়া বিশ্ববরেণ্য পির জুলফিকার আহমদ নকশবন্দির সঙ্গেও আমার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী ও আল্লামা সুলতান যওক নদভী আমাকে তরিকতের খিলাফত প্রদান করেছেন।
* আমরা আপনার জীবনের বিশেষ স্বপ্ন-ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাই।
আ ফ ম খালিদ হোসেন : আমার একটা স্বপ্ন ছিল-ইসলামের আদলে এ দেশ যেন একটি মডেল রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠে। হজরত ওমর (রা.)-এর আদলে দেশে একটি সুন্দর শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠুক। কিন্তু এটি তো আমার একার দ্বারা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এতে সবার সহযোগিতা দরকার। তবে আমি যে বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছি সেখানে যদি আমি ইনসাফের সঙ্গে কাজ বাস্তবায়ন করতে পারি, দুর্নীতিমুক্ত করতে পারি এটাও কম নয়। আমার সাধ্যমতে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে যারা এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে তাদেরও সহায়তা করব।
অনুলিখন : কাজী ইনজামামুল হক