Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামি মূল্যবোধের অনুশীলন জরুরি

Icon

আল মামুন

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামি মূল্যবোধের অনুশীলন জরুরি

ইসলাম সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারি ও বিশ্বস্ততার গুণাবলি অর্জনের নির্দেশনা দেয়। পাশাপাশি একটি শৃঙ্খল ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিও জোর দেয়। কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তার জন্য পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তির বিধানও দিয়েছে ইসলাম। দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার নিয়ে যুগান্তরের মুখোমুখি হয়েছে দেশবরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ ও কুরআন গবেষক মাওলানা শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন। তিনি জামালী তালিমুল কুরআন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ২৪ ঘণ্টায় কুরআন শিক্ষা মেথডের আবিষ্কারক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল মামুন

সমাজে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? এ সম্পর্কে কুরআন কী বলে?

দুর্নীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ রীতি বা নীতিবিরুদ্ধ আচরণ, কুনীতি, নীতিহীনতা ইত্যাদি। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘ফাসাদ’ এবং ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘করাপশন’। পরিভাষায় দুর্নীতি বলতে সাধারণত ঘুস, অর্থ আত্মসাৎ, বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, স্বজনপ্রীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্পিত দায়িত্বের অপব্যবহার করা বোঝায়। কেউ কেউ বলেন, দুর্নীতি হলো অসততা, অবৈধ আচরণ, বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিদের আইনবহির্ভূত আচরণ ইত্যাদি। দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। এটি মহামারির মতো কোনো জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং আমাদের প্রিয় নবি (সা.) বিভিন্ন হাদিসের মাধ্যমে মানব জাতিকে দুর্নীতির বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন।

কোনো জাতি ধ্বংসের আগে তাদের মধ্যে দুর্নীতি মহামারির মতো বিস্তার লাভ করে থাকে। মহান আল্লাহ যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিকে শাস্তি দেওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ‘যখন কোনো জাতি দেশে সীমালঙ্ঘন ও দুর্নীতি করেছে, তখন তাদের ওপর তোমার প্রভু শাস্তির কশাঘাত হানলেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক গভীরভাবে তোমাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।’ (সূরা ফজর, আয়াত ১১-১৪)। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, যখন দেশে আইন ও অধিকারের সীমা লঙ্ঘিত হয়, মহান আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা হয় এবং দুর্নীতি বিস্তারের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়, অর্থাৎ দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে, তখন মহান আল্লাহতায়ালা ওই দেশ ও জাতির ওপর ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের নানাভাবে শাস্তি দেন।

দুর্নীতিবাজ কতিপয় ব্যক্তি ফুলেফেঁপে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়। যা আসলে সাধারণ জনগণেরই সম্পদ। এভাবে অন্যের অধিকার হরণ করার বিষয়ে ইসলাম কী বলে?

মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে অন্যের অধিকার হরণ করাকে বহুবার হারাম ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে। আর তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট! নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৫৮)।

তিনি পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে বিধান অমান্যকারীদের জন্য শাস্তির বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে আমাদের সতর্ক করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে অধিকার করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশও জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে মালিক হওয়ার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ কোরো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৮)। মহানবি (সা.) হারাম উপার্জনে উম্মতকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি এরশাদ করেন, ‘হারাম খাদ্য ও পানীয়ে বর্ধিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মিশকাত)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ১০ দিরহামে একটি কাপড় পরিধান করে, যার মধ্যে ১ দিরহাম হারাম থাকে, তার পরিধানে ওই কাপড় থাকা অবস্থায় আল্লাহতায়ালা তার নামাজ কবুল করেন না।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

মানুষ লোভ-লালসা থেকে দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে ছাগলের পালে ছেড়ে দেওয়া হলে তা যতটুকু না ক্ষতি সাধন করে, কারও সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চেয়েও বেশি ক্ষতি সাধন করে তার ধর্মের।’ (তিরমিজি শরিফ)। তাই নিজের দ্বীনের জন্য অবশ্যই লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। আর লোভ-লালসা ত্যাগ করা গেলে দুর্নীতিও কমে যাবে। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, ‘রাসূল (সা.) ঘুসদাতা ও গ্রহীতাকে অভিশাপ দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ শরিফ)।

অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে ঘুসদাতা ও গ্রহীতা দুজনই সমান অপরাধী-দুর্নীতিবাজ। ঘুসের লোভে পড়ে অনেকে কোটি কোটি মানুষের হক নষ্ট করে, যা জুলুমের শামিল। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে, তারা রাষ্ট্রের সব নাগরিকের ওপর জুলুম করে। কেয়ামতের কঠিন দিনে তারা কতজন মানুষের ওপর জুলুমের প্রায়শ্চিত্ত করবে? কতজনের হক আদায় করতে সক্ষম হবে? মহান আল্লাহ আমাদের দুর্নীতি নামক অভিশাপ থেকে হেফাজত করুন।

দুর্নীতির কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি জমি। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামের নির্দেশনা জানতে চাই।

দুর্নীতি দমনে মহানবি (সা.) শান্তি ও সুনীতির যে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে বিদ্যমান দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব। ইসলাম অপরাধী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পার্থিব শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছ আইন এবং তা দ্রুত কার্যকর করার বিধান প্রণয়ন করেছে। ইসলামে কোনো অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, এমনকি খুনির শাস্তি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ক্ষমা করার বিধান রাখা হয়নি। কারণ এতে অপরাধীদের ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অপকর্ম করার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

এ জন্য মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমা চুরি করলেও আমি তার হাত কেটে দেব’ (বুখারি)। ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’। (সূরা মায়িদা, আয়াত ৩৩)।

অসৎ ও হারাম উপায়ে উপার্জনের প্রবণতা থেকেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি দমনের মূলনীতি হিসাবে ইসলাম হালাল-হারামের পার্থক্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। সেই সঙ্গে হালালের উপকারিতা এবং হারামের অপকারিতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৬৮)।

আখেরাতের ভয় একটি সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত শুদ্ধ সমাজে পরিণত করতে পারে বলে মনে করেন কি?

অবশ্যই। কেবল আখেরাতের ভয়ই একটি সমাজকে শুদ্ধ সমাজে পরিণত করতে পারেন। যার দৃষ্টান্ত হুজুর (সা.) নিজে করে দেখিয়েছেন। দুনিয়ায় অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক, আখেরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। দুনিয়ায় মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখেরাতে আল্লাহর দরবারে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না; বরং সব কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। সেখানে কোনো বিষয়ে দুর্নীতি, ব্যক্তি বা জাতির হক আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং পরিণামে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তা থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। সেদিন হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৬৫)। আল্লাহর সামনে হিসাব দিতেই হবে-এ মানসিকতা জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি হলে দুর্নীতি ও অপরাধ কমে আসবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ জন্য প্রথমেই পারিবারিক পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ একজন শিশুর ওপর পরিবারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি থাকে।

তাই প্রত্যেক মা-বাবার উচিত, সন্তানকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামি অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসাবে গড়ে তোলার সুব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তা হচ্ছে সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনের লক্ষ্যে ইসলামি মূল্যবোধ ও তাকওয়ার ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম