
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৪৩ এএম
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ কি ভারতে বড় ধরনের সংস্কারের সূচনা করবে?

বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪৭ পিএম

আরও পড়ুন
কঠিন সঙ্কটে পড়লেই, সাধারণত দেখা গেছে, ভারত অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে ঝুঁকেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ১৯৯১ সালে দেশটি যখন গভীর আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি পড়ে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হেঁটেছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন একতরফাভাবে শুল্ক হার ঘোষণা করে দিয়েছেন, এরপরেই বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যে একটা উথালপাথাল শুরু হয়ে গেছে।
এই সময়ে অনেকে মনে করছেন যে ভারত আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি তার সংরক্ষণ-বাদ ঝেড়ে ফেলে তার অর্থনীতিকে আরও উদার করে দেবে? তিন দশক আগে তারা যেমন করেছিল, সেভাবেই কি ভারত এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে না কি তারা আরও পশ্চাদপসরণ করবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প বার বার ভারতকে ‘শুল্কের মহারাজ’ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বড় অপ-ব্যবহারকারী’ বলে অভিহিত করে আসছেন।
সমস্যা হলো ‘ট্রেড ওয়েটেড ইম্পোর্ট ডিউটি’ অর্থাৎ আমদানিকৃত প্রতিটি পণ্যের গড় শুল্ক – বিশ্বের যেসব দেশে সর্বোচ্চ, ভারত সেগুলির অন্যতম।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে গড় শুল্ক ২.২ শতাংশ, চীনে তিন শতাংশ আর জাপানে ১.৭ শতাংশ, সেখানে ভারতে গড় শুল্ক ১২ শতাংশ।
উচ্চ হারের শুল্ক বৈশ্বিক ‘ভ্যালু-চেইনের’ ওপরে নির্ভরশীল সংস্থাগুলোর ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা বাধা পায়।
এর আরেকটা অর্থ হলো যে অন্যান্য দেশের উপভোক্তাদের তুলনায় ভারতীয়রা আমদানি করা পণ্য কিনতে বেশি খরচ করেন।
যদিও রফতানি ক্রমেই বাড়ছে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো পরিষেবা রফতানি, তবু ভারতের গুরুতর বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী রফতানিতে ভারতের অংশ মাত্র ১.৫ শতাংশ, তাই সমস্যাটার মোকাবেলা করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
মার্কিন পণ্যে শুল্ক ছাড় ভারতের
ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধি এখন ভারতকে আরও উন্মুক্ত করতে সাহায্য করবে না কি সংরক্ষণ-বাদই আরও মজবুত হবে, তা নিয়ে রায় একপ্রকার হয়েই গেছে।
যে নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে একটা সমালোচনা হচ্ছে অর্থনীতিতে তাদের সংরক্ষণবাদী পথ নিয়ে, তা ইতোমধ্যেই যে পথ বদলাতে শুরু করেছে, সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।
গত মাসে ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে বৈঠকের আগেই ভারত একতরফাভাবে বুরবঁ হুইস্কি, মোটরসাইকেল ও আরও বেশ কিছু মার্কিনী পণ্যের ওপরে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দেওয়ার পরেই ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রী পীযুষ গোয়েল একটা সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে দুবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ফেলেছেন।
ট্রাম্পের ঘোষণার ফলে ‘সিটি রিসার্চ’-র বিশ্লেষকরা বলছেন প্রতিবছর ভারতের ৭০০ কোটি ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। ধাতব ও রাসায়নিক পণ্য, গয়না, ওষুধ ও গাড়ি শিল্প এবং খাদ্যপণ্য ক্ষেত্রগুলিতেই প্রাথমিক ধাক্কাটা পড়বে।
গত মাসে গোয়েল ভারতীয় রফতানিকারকদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তারা নিজেদের সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যের মনোভাব ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং কঠোর মনোভাব আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বের মোকাবেলা করেন।
যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেরসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ভারত বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়েছে এরই মধ্যে। ট্রাম্পের সহযোগী ইলন মাস্কের সংস্থা ‘স্পেস এক্স’ কৃত্রিম উপগ্রহ ভিত্তিক যে স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট পরিষেবা আনতে চলেছে, ভারতে সেই পরিষেবার জন্য দুটি বৃহৎ দেশীয় টেলিকম সংস্থা রিলায়েন্স জিও এবং ভারতী এয়ারটেল ইতোমধ্যেই হাত মিলিয়েছে ‘স্পেস এক্স’র সঙ্গে।
চীনের কৌশল কি নিতে পারবে ভারত?
ওষুধ, সফ্টওয়্যার, গাড়ি, বস্ত্র এবং পোশাক শিল্পসহ ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য যেভাবে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং শুল্কও ক্রমাগত কমানো হয়েছে, মূলত তার ফলেই গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার দ্রুত বেড়েছে বলে মনে করা হয়।
অনেক অর্থনীতিবিদ বিশ্বাস করেন যে গত এক দশকে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির ফলে সংরক্ষণবাদী নীতি কিছুটা সমস্যাতেও পড়েছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিতে বস্ত্র শিল্পের মতো শ্রম-নির্ভর ক্ষেত্রের চেয়ে পুঁজি ও প্রযুক্তি নির্ভর ক্ষেত্রগুলির ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। যার ফলে উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ভারতের অর্থনীতিকে।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অর্থনীতির অধ্যাপক বিরল আচার্যের মতে, উচ্চ শুল্ক ভারতের বেশ কয়েকটি শিল্পে সংরক্ষণবাদকে উসকে দিয়েছে, যা দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে।
এ কারণে খুব বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন না হয়েও কিছু সংস্থা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া দিয়েই বাজার ধরে রাখার ক্ষমতা পেয়ে গেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্মকর্তা আচারিয়া ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি প্রবন্ধে লিখেছেন যে ভারতে শিল্পগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করতে ‘শুল্ক হার কমিয়ে বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যে ভারতের অংশীদারিত্ব বাড়ানো এবং সংরক্ষণবাদী নীতি আলগা করার দরকার।’
বেশিরভাগ দেশের তুলনায় ভারতের শুল্ক-হার ইতোমধ্যেই অনেক বেশি, তা আরও বাড়ালে অর্থনীতির ক্ষতি হবেই।
মুম্বাই-ভিত্তিক ইন্দিরা গান্ধী ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের সহযোগী অধ্যাপক রাজেশ্বরী সেনগুপ্ত বলেন, আমাদের রফতানি বাড়াতেই হবে এবং এই পাল্টাপাল্টি শুল্কের লড়াই আমাদের সহায়তা করবে না। চীন এই কৌশল নিতে পারে, কারণ তাদের রফতানির প্রকাণ্ড বড় বাজার আছে। কিন্তু আমরা সেই ঝুঁকি নিতে পারি না, কারণ বৈশ্বিক বাজারে আমাদের অংশীদারিত্ব নগণ্য।
তার কথায়, বাণিজ্য সংঘাত অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমাদেরই বেশি ক্ষতি করবে।
ভারত দাঁড়িয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে
ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অসীমা সিনহা বলেন, এই পরিস্থিতিতে ভারত এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। বিশ্ব জুড়ে যখন একটা বড়সড় বদল ঘটতে চলেছে, তখন ভারতের সামনে রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার এক অভূতপূর্ব সুযোগ।
গ্লোবালাইজিং ইন্ডিয়া বইয়ের লেখক মিজ সিনহার মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় সুরক্ষাবাদ কমিয়ে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ভারত নতুন বাণিজ্য কাঠামো গঠনের নেতৃত্ব দিতে পারে, যা তাকে "পুনর্বৈশ্বিকীকৃত" বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।
তিনি বলেন, শুল্ক হার কমিয়ে দিলে আঞ্চলিক ও আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারত একটা চুম্বকের মতো কাজ করতে পারে । আর এর ফলে এই ক্ষেত্রের নানা শক্তিগুলিকে আকর্ষণও করবে ভারত।
স্বদেশে ভীষণভাবে জরুরি যে চাকরির বাজার, সেটাও গড়ে তুলতে পারবে ভারত। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১৫ শতাংশই যেখানে কৃষিক্ষেত্র থেকে আসে, সেখানে কাজের সুযোগ ৪০ শতাংশ। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে উৎপাদনশীলতা কতটা কম।
নির্মাণ শিল্পে দ্বিতীয় সর্বাধিক কাজের সুযোগ রয়েছে, তবে সেখানে বেশিরভাগই দিনমজুররা যোগ দেন।
ভারতের ক্রমবর্ধমান পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধিটা বড় চ্যালেঞ্জ নয়। এই ক্ষেত্র থেকেই মোট রফতানির প্রায় অর্ধেক হয়ে থাকে। দেশটির সামনে চ্যালেঞ্জ এটা যে কীভাবে বিপুল সংখ্যক অদক্ষ শ্রমিককে কাজে লাগানো যেতে পারে।
তবে শুল্ক কমানোর ব্যাপারে একটা বিপদও আছে। এর ফলে ‘ডাম্পিং’ হতে পারে, অর্থাৎ বিদেশি সংস্থাগুলো তাদের সস্তার পণ্য দিয়ে বাজার ভরিয়ে দিতে পারে, যার ফলে দেশীয় শিল্প মার খাবে।
সেনগুপ্তর কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীন ভারতে কিছুদিনের জন্য তাদের পণ্য সস্তায় বাজারজাতকরণের (ডাম্পিং) ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ থেকে রক্ষা পেতে ভারত যেটা করতে পারে যে শুধুমাত্র চীনের ক্ষেত্রে 'নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার্স' ব্যবহার করতে পারে। সেটাও শুধুমাত্র যে সব ক্ষেত্রে ডাম্পিং করার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
বিশ্বের জন্য পণ্য উৎপাদন করতে যে কাজের সুযোগ তৈরি করা দরকার, সেটা সহজ হবে না। অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে কম দামি পণ্য উৎপাদনের মডেল চীন কয়েক দশক ধরেই সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত সেদিক থেকে ইতোমধ্যেই পিছিয়ে গেছে। আবার যন্ত্রচালিত উৎপাদনও বাড়ছে।
এখন বড়সড় সংস্কার না করলে ভারতের পিছিয়ে পড়ার সমূহ শঙ্কা রয়েছে।