মনমোহন সিংকে কেন শ্রদ্ধা জানালেন না শাহবাজ শরিফ?
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৮ পিএম
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গত সপ্তাহে মারা যান। তার মৃত্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শোক প্রকাশ করে বার্তা এসেছে। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ‘বন্ধু ও ভাই’ হিসেবে স্মরণ করেছেন মনমোহন সিংকে। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তেমন সৌজন্য দেখা যায়নি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাননি, তার বড় ভাই তথা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের তরফেও তেমন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বেশ আলোচনা হচ্ছে। শরিফের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পাকিস্তানের অনেকেই।
মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ ইউনূস। সেখানে মনমোহন সিংয়ের একটি প্রতিকৃতি রাখা হয়েছিল, ইউনূস সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর একটি বার্তাও জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা। ভার্মার সঙ্গে কথাও বলেছেন মোহাম্মদ ইউনূস।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে পৃথক অস্তিত্ব লাভ করেছিল বাংলাদেশ, সেই সময় ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। গান্ধী-নেহরু পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের ভালো সম্পর্কও কারও অজানা নয়।
তবে সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সমীকরণে বদল এসেছে। বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসার পর শেখ হাসিনা আপাতত ভারতেই ঠাঁই নিয়েছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েনও চলছে।
শ্রদ্ধা জানাননি পাক প্রধানমন্ত্রী
এদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও পর্যন্ত প্রয়াত মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, তার বড় ভাই তথা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও স্মরণ করতে দেখা যায়নি ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদকে।
যদিও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন শাহবাজ শরিফ। দক্ষিণ কোরিয়ায় বিমান দুর্ঘটনাতেও তিনি শোক প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে মনমোহন সিংয়ের বিষয়ে তাকে নীরব থাকতে দেখা গিয়েছে।
অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ড. মনমোহন সিং। যেখানে তার জন্ম সেই অঞ্চল এখন পাকিস্তানের পাঞ্জাবে।
শ্রদ্ধা বা স্মরণ ইস্যুতে শাহবাজ শরিফের অবস্থান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে যেমন পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক শিবির তার মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তেমনই সে দেশের সাংবাদিক এবং বিশেষজ্ঞদেরও শরিফের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছে।
পাকিস্তানে সমালোচনা
শাহবাজ ও নওয়াজ শরিফের সমালোচনা করে ইমরান খান সরকারের সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী ফাওয়াদ হুসেন লিখেছেন, শরিফ পরিবার মোদি এবং অন্যান্য মুসলিমবিরোধী ভারতীয় নেতাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা মনমোহন সিংকে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা পর্যন্ত জানাননি।
শাহবাহ শরিফের সমালোচনা করতে ছাড়েননি পাকিস্তানি সাংবাদিক আমারা আহমেদও। শরিফকে নিশানা করে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান যে মনমোহন সিংকে শ্রদ্ধা জানায়নি সেটি অত্যন্ত তুচ্ছ মানসিকতাকে দর্শায়।
কেন এ সিদ্ধান্ত?
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এহেন সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বিভিন্নজন নানারকম মত প্রকাশ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, শাহবাজ শরিফ বা নওয়াজ শরিফ কেউই প্রকাশ্যে মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাননি। পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ইসহাক দার অবশ্য একটি বার্তা দিয়েছেন। এটা হতবাক করে দেওয়ার মতো বিষয়।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন এই পদক্ষেপের পিছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। তার ধারণা, শরিফ নরেন্দ্র মোদিকে ‘অসন্তুষ্ট’ করতে চান না। অথবা পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
মাইকেল কুগেলম্যানের টুইটের জবাবে আয়েশা সিদ্দিকা লিখেছেন, মনে হচ্ছে শরিফ পরিবার মোদিকে অসন্তুষ্ট করতে চায় না। নাকি পিএমএলএনের যে পুরনো অবস্থান ছিল তা এখন চলে গিয়েছে?
তবে আয়েশা সিদ্দিকার তোলা প্রশ্নের প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেছেন, আমার মনে হয় না যে শরিফ পরিবার মোদির অসন্তুষ্ট হওয়া নিয়ে এতটা মাথা ঘামাবে। আমি এই বিষয়টা নিয়ে নিশ্চিত নই যে মনমোহন সিংকে শ্রদ্ধা জানালে মোদি অসন্তুষ্ট হয়ে যেতেন।
মাইকেল কুগেলম্যানের মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না পাকিস্তানি সাংবাদিক আমির মির্জা। তার পাল্টা যুক্তি হলো, শরিফ পরিবারে না কোনো সিরিয়াস রাজনীতিবিদ রয়েছেন না কোনো রাষ্ট্রনায়ক। আমরা তাদের কাছ থেকে কোনোরকম মর্যাদাপূর্ণ আচরণ আশা করতে পারি না।
শরিফের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক যে ঘনিষ্ঠতার সে দাবিও জানিয়েছেন এই সাংবাদিক। তার কথায়, মোদির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা তো সকলেরই জানা আছে।
প্রসঙ্গত, তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শাহবাজ শরিফ ও নওয়াজ শরিফ দুজনেই।
পাকিস্তানি সাংবাদিক মোনা ফারুক আহমেদ এ প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আমাদের প্রতিবেশী এবং রাষ্ট্রনায়ক দুই-ই ছিলেন। দুই দেশের সম্পর্ক ভালো না হলেও পাকিস্তানের কাছ থেকে তার শ্রদ্ধা পাওয়া উচিত ছিল।
বিদেশনীতি ও পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্কের চেষ্টা
প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা মনমোহন সিং সরকারের কাছে বরাবরই গুরুত্ব পেয়ে এসেছিল। সেই তালিকায় পাকিস্তানও ছিল।
তার বিষয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে একটি দীর্ঘ পোস্টে লিখেছেন, আমরা ১৯৯০ এর দশকে মনমোহন সিংয়ের অর্থনৈতিক নীতির সাক্ষী। নব্বইয়ের দশকে আমি মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রীও ছিলাম। মনমোহন সিং একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এবং আগামী প্রজন্ম তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছেন সাবেক ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার পঙ্কজ সরণ।
এনএসএ-র সাবেক কর্মকর্তা সরণ মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুর পর বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি (মনমোহন সিং) বরাবরই একজন দুর্দান্ত শ্রোতা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্বমানের অর্থনীতিবিদ, সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন। ২০০৮ সালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতে তিনি প্রথম (ভারতীয়) প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিশ্ব নেতাদের মধ্যে উচ্চখ্যাতি অর্জন করেছিলেন যাদের অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো বিবেচনা রয়েছে... সব মিলিয়ে আমি বলব, ব্যক্তিগত এবং কর্মজীবন উভয় ক্ষেত্রেই খুব ভালো মানুষ, দুর্দান্ত মানুষ ছিলেন।
এই সাবেক ডিপ্লোম্যাট বলেছেন, তিনি মনে করতেন পশ্চিমাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়েও তিনি সচেষ্ট ছিলেন এবং তা না হওয়ায় হতাশও হয়েছিলেন।
পাকিস্তানের সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ
শেকড় পাকিস্তানে হলেও দেশ ভাগের সময় মনমোহন সিংয়ের পরিবারকে তাদের ভিটে ছাড়তে হয়েছিল। সেই সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর। শরণার্থী হিসেবে সীমান্তের অপর প্রান্তে চলে এসেছিলেন তারা।
মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করেছিলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক নাজাম শেঠি, তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জুগনু মহসিন।
ওই বৈঠকের স্মৃতিচারণ করে শেঠি পাকিস্তানি নিউজ চ্যানেল সামা টিভিকে বলেন, ২০০৪ সালে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মনমোহন সিং তখন সবেমাত্র প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সেই সময় আমি ভারতে ছিলাম। তখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন জে এন দীক্ষিত।
তিনি বলেন, জে এন দীক্ষিত পাকিস্তানে ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন এবং আমি তাকে খুব ভালোভাবে চিনতাম। তাকেই অনুরোধ করেছিল যে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিন। আমাদের বৈঠক স্থির হয়।
স্মৃতি হাতড়ে পাকিস্তানি সাংবাদিক বলেছেন, মনমোহন সিং পুরো সময় পাঞ্জাবিতে কথা বলেছিলেন। আমার স্ত্রী জুগনু মনমোহন সিংকে বলেছিলেন- আপনি যে পাকিস্তানে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তার বিষয়ে কিছু বলুন।
মনমোহন সিং তার স্কুল জীবনের সব কথা সবিস্তারে বলেন। মনমোহন সিং জানিয়েছিলেন, তার শিক্ষকদের সকলেই মুসলিম ছিলেন, বলেন শেঠি।
শেঠি আরও বলেন, মনমোহন সিং তার পুরো পড়াশোনা উর্দু মাধ্যমে করেছেন এবং হিন্দি জানতেন না। তিনি হিন্দি পড়তেন ফারসি লিপিতে। মনমোহন সিং পাকিস্তানের পাঞ্জাবে তার গ্রাম ও স্কুল দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আমি যখন ফিরে আসি তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চৌধুরী সুজাত হুসেন।
দেশে ফিরে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সে কথা জানান শেঠি।
তিনি বলেন, চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি চৌধুরী সুজাতকে বলেছিলাম যে আমি মহামোহন সিংয়ের সাথে দেখা করে এসেছি। তার গ্রামের স্কুল মেরামত করুন কারণ মনমোহন সিং একবার সেটা দেখতে চান। চৌধুরী সুজাত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্কুল মেরামত করলেও মনমোহন সিং পাকিস্তানে আসতে পারেননি।