ইসরাইল গাজায় ‘যুদ্ধাপরাধ’ করছে: জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৯ পিএম
ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং চিকিৎসাকর্মীদের হত্যা ও নির্যাতন করছে। এ ঘটনাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে অভিযোগ করেছেন জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘গাজার ওপর ব্যাপক আক্রমণের অংশ হিসেবে ইসরাইল একটি সংগঠিত নীতি গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা’।
কমিশন আরও জানায়, ‘ইসরাইল চিকিৎসাকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিরবচ্ছিন্ন ও ইচ্ছাকৃত আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অপরাধ করছে’।
জাতিসংঘের তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিশনটি ২০২১ সালের মে মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল দ্বারা গঠিত হয়। যাদের কাজ ছিল ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করা।
সম্প্রতি তাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, যা গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পরে গাজায় ইসরাইলের চলমান আগ্রাসনের পটভূমিতে করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন এবং গাজায় আটক ব্যক্তিদের ওপর ‘যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা’সহ নানা অত্যাচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস উভয়কেই নির্যাতন এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে ইসরাইলি সরকার কমিশনের এই তদন্তকে ‘পদ্ধতিগতভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বৈষম্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং এর আগের প্রতিবেদনের মতো এবারের প্রতিবেদনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। আগের প্রতিবেদনেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংস
তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রধান নাভি পিল্লাই বলেছেন, ‘ইসরাইল গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু করে জনস্বাস্থ্যের অধিকারের ওপর আঘাত হানছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তাই গাজার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ইসরাইলি বাহিনীর এই অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’।
প্রতিবেদনে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গাজায় ‘ইচ্ছাকৃতভাবে চিকিৎসাকর্মী হত্যা, আটক এবং নির্যাতন’ এবং চিকিৎসা যানবাহনকে লক্ষ্যবস্তু করার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে বের হতে পারমিট দেওয়ার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ধরনের পদক্ষেপগুলোকে যুদ্ধাপরাধ এবং ‘মানবতার বিরুদ্ধে গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন।
কমিশন জানায়, ইসরাইলের কর্মকাণ্ড আহত শিশুদের মধ্যে ‘অপূরণীয় কষ্ট’ সৃষ্টি করছে এবং ‘ফিলিস্তিনি শিশুদের একটি প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে’।
প্রতিবেদনে চলতি বছরের জানুয়ারিতে হিন্দ রাজাব নামের এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। গাজা সিটিতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শিশুটি পালিয়ে গিয়ে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টকে সাহায্যের জন্য ডেকেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ৬ জন আত্মীয় ও দুজন রেড ক্রিসেন্ট উদ্ধার কর্মীর সঙ্গে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
কমিশন বলেছে, ইসরাইলের ১৬২তম ডিভিশন এই হত্যার জন্য দায়ী, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল।
বন্দিদের ওপর নির্যাতন
তদন্ত কমিশনের এই প্রতিবেদনে ইসরাইলি সামরিক শিবির ও বন্দি শিবিরে ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতি আচরণের ওপরও আলোকপাত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজার হাজার বন্দিকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। এ ধরনের নির্যাতন এবং অবহেলার কারণে বন্দির মৃত্যুর ঘটনাও যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেছে কমিশন।
কমিশন জানায়, এই ‘প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার’ ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গাভিরের সরাসরি আদেশে পরিচালিত হয়েছে। যা সহিংসতা এবং প্রতিশোধের আহ্বান জানিয়ে দেওয়া ইসরাইলি সরকারের বক্তব্যে সরাসরি উসকানি পেয়েছে।
বন্দিদের নির্যাতন
এদিকে গাজার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে বন্দি থাকা ইসরাইলি ও অন্যান্য বন্দিদের বিষয়েও তদন্ত প্রতিবেদনে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বহু বন্দিকে শারীরিক কষ্ট এবং তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। যার মধ্যে ছিল সহিংসতা, অপব্যবহার, যৌন নির্যাতন, অপমান এবং খাদ্য ও পানির সীমিত প্রাপ্তি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও নির্যাতন, অমানবিক আচরণ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে’।
সেই সঙ্গে কমিশনের চেয়ারম্যান নাভি পিল্লাই সমস্ত বন্দিদের অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
এদিকে গাজায় ইসরাইলি হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪২,০৬৫-তে পৌঁছেছে। আহতের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। সূত্র: আল-আরাবিয়্যাহ