Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

দেব-দেবীর জন্য পরচুলা তৈরি করে মুসলমান প্রধান যে গ্রাম

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৪ এএম

দেব-দেবীর জন্য পরচুলা তৈরি করে মুসলমান প্রধান যে গ্রাম

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও দেব-দেবীর কেশসজ্জার জন্য পরচুলা তৈরির করেন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার কুলাই গ্রামের শেখপাড়ার মুসলমান বাসিন্দারা। বহু যুগ ধরে বংশপরম্পরায় তারা এই কাজ করছেন।

মুসলিম প্রধান এ গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাই পরচুলা তৈরির সঙ্গে যুক্ত।

দুর্গাপুজোর সময় তো ব্যস্ততা থাকেই, পাশাপাশি সারা বছর বিভিন্ন মন্দিরে বিগ্রহের জন্য চুল সরবরাহ করেন গ্রামের বাসিন্দারা। পাশাপাশি চামরও তৈরি করেন তারা।

তাদেরই একজন মালেকা বেগম। তার রোজনামচা বাঁধা, সকাল থেকেই একদিকে বাড়ির কাজ সামলানো আর অন্যদিকে স্বামী আর ছেলের সঙ্গে কাজে হাত লাগানো।

‘৩২ বছর হলো বিয়ে হয়ে এসেছি এই বাড়িতে। তখন থেকেই ঠাকুরের (দেব-দেবীর বিগ্রহের) জন্য চুল আর চামর বানানোর কাজ শুরু করেছি। আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামীর সঙ্গে কাজ করতাম। এখন তো ছেলে, ছেলের বউও আমাদের সঙ্গে কাজ করে,’ বলেছিলেন মালেকা বেগম।

বারান্দার এক পাশে কাজ করে চলেছেন তার স্বামী এব্রাহিম মল্লিক। বললেন, ‘এই মরশুমে পরপর অনেক কাজের অর্ডার আসে। কিছুদিন আগেই জন্মাষ্টমীর জন্য গোপাল আর রাধারানির চুলের অর্ডার ছিল। তারপর পুজোর (দুর্গা পুজো) অর্ডার। এই ব্যস্ততা এখন চলবে।’

পাশের একটা ছোট ঘরে তার ছোট ছেলে মণিরুল মল্লিক এক মনে চামর তৈরির কাজ করে চলেছেন। মাঝে মাঝে এ কথোপকথনে যোগ দিচ্ছিলেন।

তিনি বলছিলেন, তাদের কাজ কীভাবে দিল্লি, মুম্বাই, রাজস্থানে যায়। তাদের কাজের সুনামের কথাও। বড় ছেলে বাজারে গিয়েছেন দুর্গাপূজার অর্ডারের কাজ দোকানে পৌঁছে দিতে।

গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত রুস্তম আলি ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী। কুলাইয়ে পরচুলা শিল্প যাদের হাত ধরে বিকশিত হয়েছে, প্রয়াত এই শিল্পী তাদের মধ্যে অন্যতম।

তার ছেলে শেখ মেহরাজ আলী জানিয়েছেন, প্রায় গোটা বছরই হিন্দু দেব-দেবীর জন্য কৃত্রিম কেশ তৈরির বায়না আসে।

‘এক একটা মরশুমে এক ধরনের অর্ডার আসে। দুর্গাপূজার আগে একটা মাস দেবীর পরচুলার কাজ হয়। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ছত্তিশগড়, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশে দেব-দেবীদের চুল যায়। তার আগে জন্মাষ্টমীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের অর্ডার থাকে। কালীপূজায় পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বাইরে থেকে অর্ডার আসে,’ বলেছিলেন তিনি।

শেখ মেহরাজ আলী জানিয়েছেন, কুলাই গ্রামের শেখ পাড়ার বাসিন্দাদের সিংহভাগই পরচুলা তৈরি করেন।

মুসলিম প্রধান এই অঞ্চলে কাঁচা-পাকা মিলিয়ে প্রায় ৪০০-এর কাছাকাছি বাড়ি। গ্রামের কমপক্ষে ২৫০টা পরিবার সরাসরি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত।

পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুরসহ একাধিক জেলাতে দেব-দেবীর পরচুলা তৈরি হয়।

‘কুলাই গ্রামে মুসলমান শিল্পীরা হিন্দু দেব-দেবীদের জন্য পরচুলা তৈরি করেন। এই সম্প্রীতি মানুষের মন ছুঁয়ে গিয়েছে। মুসলমান শিল্পীরা যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজ করেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এটাই কুলাইকে অন্য জায়গাগুলোর চেয়ে আলাদা করে। রুস্তম আলী রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়াও কুলাইকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে,’ বলেছেন হাওড়ার বাসিন্দা সৌম্য গাঙ্গুলি।

‘বংশ পরম্পরায় এটাই আমাদের পেশা’

একসময় মূলত যাত্রাপালা এবং নাটকের জন্য পরচুলা তৈরি করতেন গ্রামের বাসিন্দারা। তবে গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এদের অনেকেই শুধুমাত্র হিন্দু দেব-দেবীদের বিগ্রহের জন্য চুল তৈরি করেন। দেব-দেবীর বিগ্রহের কেশসজ্জা নিখুঁত করে তোলাই তাদের কাজ।

‘বাবা ঠাকুরের চুল তৈরি করতেন। তার কাছ থেকেই কাজ শিখেছি। উনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে নিখুঁত করে সাজিয়ে তুলতে হয় গোপাল আর রাধারানির চুল। বিভিন্ন মাপের মূর্তির চুল তৈরি করতে হয়। তার ধরন আর সাজও আলাদা আলাদা,’ বলছিলেন এব্রাহিম শেখ।

‘আমি ৫০ বছর ধরে ঠাকুরের চুল বানাই। আমার ছেলেরাও একই কাজ করে। এটা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। এই গ্রামের ঘরে ঘরে লোকেরা একই কাজ করে, উঁকি দিলেই দেখতে পাবেন।’

হাওড়ার পাঁচলা থানার অন্তর্গত কুলাইয়ের শেখপাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দারাই বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে এই কাজ করে এসেছেন।

তিন প্রজন্ম ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মেজাফ্ফর শেখের পরিবার। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের খানদানি কাজ। আমার বাবা হামিদ শেখ, দাদা খোদাবক্ত দুজনেই পরচুলা বানাতেন। নামকরা শিল্পী ছিলেন তারা। এখন আমি বানাই। তবে, গত বাইশ-তেইশ বছর ধরে শুধু ঠাকুরের চুলই বানাই।’

‘আগে ঠাকুরের চুলের পাশাপাশি যাত্রাপালা আর নাটকের জন্যও পরচুলা তৈরি হতো। এখন তো যাত্রা তেমন হয় না। লকডাউনের পর থেকে নাটকের জন্য পরচুলার অর্ডারও আগের চেয়ে কম পাই। তাই পুরোটাই ঠাকুরের চুল তৈরির উপর নির্ভর করতে হয়।’

মথুরা, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং ওড়িশা থেকে সবচেয়ে বেশি রাধা আর কৃষ্ণের কেশসজ্জার কাজের বায়না আসে বলে তিনি জানিয়েছেন।

রুস্তম আলীর মেয়ে রমিশা বেগম বেশ গর্বের সুরেই বললেন, ‘এই পেশা আমাদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। বাবা নাম করা শিল্পী ছিলেন। ওকে দেখেই গ্রামের বহু ছেলে এই কাজকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। বাবার হাত ধরে অনেকে নিজের ব্যবসাও শুরু করেছে।’

রমিশা বেগমের ভাই এবং তাদের পরের প্রজন্ম এখন সেই পরম্পরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর এখন আমার ভাই আর তাদের ছেলেরা এই কাজ করছে। সারাটা বছরই কাজ থাকে তবে জন্মাষ্টমী আর পুজোর (দুর্গা পুজো) সময় সবচেয়ে বেশি কাজ আসে।’

বাড়ির বাইরে দাওয়ায় বসেছিলেন শেখ জাকির আলী।

তার কথায়, দুর্গাপূজার জন্য পরচুলার অর্ডার আসে মূলত জুলাই-আগস্ট মাস থেকে। মহালয়ার আগেই বেশিরভাগ অর্ডারের কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাইরের অর্ডার হলে আরও একটু আগে কাজ শেষ করি আমরা।’

সম্প্রীতির বার্তা

মুসলিম প্রধান এই গ্রাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা বড় উদাহরণ।

মেজাফ্ফর শেখের কথায়, ‘আমরা দেবতা ভেবে কাজ করি। আমার কাছে যেমন আমার দেবতা, যার জন্য কাজ করছি তারও দেবতা। দেব-দেবীর মাথায় চড়ানো হবে যে চুল, সেই কাজ আমরা সম্মানের সঙ্গে করি। সাফসুতরো হয়ে তবে কাজে বসি।’

‘আমার বাপ-দাদার আমল থেকে হিন্দু-মুসলমানদের একসঙ্গে দেখে এসেছি। এখনও তাই-ই হচ্ছে…মুসলমানরা দুর্গা ঠাকুরের চুল বানাচ্ছে, জরি দিয়ে শাড়ি বানাচ্ছে। আর সেটা তো আজ থেকে না, আমার বাবা-দাদার সময় থেকে হচ্ছে।’

তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা, ‘আমাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বাছাবাছি নেই। জাতধর্ম নিয়ে রাজনীতিকরাই কাজ করে। আমরা করি না।’

‘প্রয়াত শিল্পী রুস্তম আলী সবসময় সম্প্রীতির বার্তা দিতেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এখানে হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তিনি এই পেশাকে সম্মান জানিয়েই পরচুলা তৈরি করেন। কুলাইয়ে এখন যে শিল্পীরা আছেন, তাঁরাও হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি সম্মান জানিয়েই কাজ করেন,’ বলেছেন সৌম্য গাঙ্গুলি।

কীভাবে হয় এই কাজ?

সাধারণত পাট বা নাইলনের সুতো দিয়ে বিগ্রহের জন্য চুল তৈরি হয়। তবে কুলাই গ্রামে মূলত পরচুলা তৈরি হয় নাইলনের সুতো দিয়ে। প্রথমে সেগুলো ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপর গুছিয়ে নিয়ে বিনুনি করা হয়। তারপর চুল তৈরির চূড়ান্ত কাজ করা হয়।

পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। বিনুনি পাকানোর কাজ মূলত নারীরাই করেন। এটাই পরচুলা তৈরির ক্ষেত্রে আসল কাজ।

কাঁচা মাল হয় সাধ্য মতো শিল্পীরা নিজেরা কিনে আনেন, বা বাড়ি এসে জোগান দিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। অর্ডারের ক্ষেত্রেও তাই।

আগে ডাকযোগের মাধ্যমে পরচুলা, চামর পাঠানো হতো। এখন হোলসেলার বা পাইকারি বিক্রেতারা বাড়ি এসে নিয়ে যান অথবা শিল্পীদের সঙ্গে কর্মরত কারিগরদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই পৌঁছে দেন।

নারীদের ভূমিকা

মেজাফ্ফর শেখ ব্যাখ্যা করেছেন, পরচুলা তৈরির কাজ, বিশেষত দেব-দেবীর কেশসজ্জার জন্য যে চুল তৈরি হয় সেখানে বাড়ির মেয়েরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

‘মেয়েরা ছাড়া এই কাজ হওয়া সম্ভব নয়। নাইলনের ওই চুল আঁচড়ানো, তারপর বিনুনি পাকানো নিখুঁত কাজ ওটা মেয়েরা ছাড়া হবেই না। চামর তৈরির জন্যও নাইলনের সুতো পাকানো খুব ধৈর্যের কাজ,’ বলছিলেন তিনি।

এরপর একটু থেমে জানালেন, তার স্ত্রীও কাজে হাত লাগাতেন। মাস তিনেক হলো স্ত্রীকে হারিয়েছেন। যে ঘরে বসে এই কথাগুলো বলছিলেন তিনি, সেখানে বসে তার স্ত্রীও কাজ করতেন।

‘তিন মাস আগে একদিন সকালে গোসল করে কাজে বসেছিল। রাধারানি আর গোপালের চুল তৈরি করছিল। কাজ করতে করতেই হঠাৎ লুটিয়ে পড়ল। কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, কিন্তু সব শেষ।’

স্ত্রীর শেষ কাজগুলো, তার চশমা, একটা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে সযত্নে গুছিয়ে রেখেছেন তিনি।

স্বজন হারানোর বেদনা তার নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে ছাপ ফেলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, ছেলে দর্জির কাজ করে। তাই তার একমাত্র আশা ভরসা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া নাতি।

স্কুল থেকে ফিরলে দাদুর পাশে বসে কাজ দেখে সে। ‘ছেলে তো এই কাজে এলো না। এখন একমাত্র ভরসা আমার এই নাতি। ওকে পাশে বসিয়ে দেখাই। নাতি যদি এই কাজে আসে তবেই আমাদের খানদানি কাজ এগোবে।’

কী বলছে নতুন প্রজন্ম?

লকডাউনের প্রভাব এই শিল্পেও পড়েছে। মেজাফ্ফর শেখে বলেন, ‘লকডাউনের সময় অনেকদিন কাজ ছিল না। আমাদের আর পুঁজি কোথায়? খুব কষ্টে কাটিয়েছি। আরও একটা বিষয় হলো বাংলায় এই কাজের দাম পাই না। রাজ্যের বাইরে তবু দাম একটু ভালো।’

একই কথা জানিয়েছেন এব্রাহিম মল্লিক। তিনি বলেন, ‘ঠাকুরের চুল আর চামর বিভিন্ন সাইজের হয়। সাইজের উপর নির্ভর করে ৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা অব্দি চুলের মূল্য পাই। আর চামরের সাইজ এবং হ্যান্ডেলের উপর নির্ভর করেভ ৩৫ টাকা থেকে ২৫০ টাকা অব্দি দাম পাই।’

‘অসুবিধা হয় না তা বলব না, কিন্তু পেট চলে যায়। খোদার মেহেরবানিতে একটু বুঝে সুঝে চললে সংসার চালিয়ে দেওয়া যায়। লকডাউনে ব্যবসা খুব মার খেয়েছে। এখন তার চেয়ে পরিস্থিতি ভালো,’ তিনি বলেন।

বাসিন্দাদের কেউ কেউ আবার উদ্বিগ্ন নতুন প্রজন্ম এই শিল্পকে কী তাদের পেশা করবে?

রমিশা বেগমের ইচ্ছা, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া নাতিও এই একই পেশা বেছে নিক। যাতে বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই শিল্প থমকে না যায়।

এই এলাকার একটা ঘরে দুই প্রজন্মের দুই কারিগর চামর তৈরির কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন বছর ষোলোর শেখ আজিম। তার কথায়, ‘আমি অভাবের জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি। গত চার বছর চামর বানানোর কাজ করছি। আমার ভালোই লাগে এই কাজ করতে।’

কুড়ির কোঠায় থাকা মণিরুল মল্লিকও কিন্তু নিজের পেশাতেই খুশি। কাজের ফাঁকে মোবাইলে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে ভালবাসেন তিনি।

‘বাবা-দাদা যে কাজ করে এসেছেন, আমিও সেই কাজই করতে চাই। আমার ইচ্ছে অন্য রাজ্যে আরও বেশি করে কাজ পৌঁছে দেওয়ার যাতে সবাই কুলাইয়ের কথা জানতে পারে,’ তিনি বলেছিলেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম