হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর ইতিবৃত্ত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ ছিলেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে ৩২ বছরের দীর্ঘ প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি। শুক্রবার রাতে লেবাননের বৈরুতে ইসরাইলের বাঙ্কার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিনি নিহত হন।
নাসরুল্লাহর শৈশব ও রাজনৈতিক উত্থান
হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ সালের ৩১ আগস্ট লেবাননের বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন এবং বুর্জ হাম্মুদ এলাকায় বেড়ে ওঠেন। শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নাসরুল্লাহ শিক্ষাজীবনেই আমাল আন্দোলনে যোগদান করেন।
তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা টায়ার শহরেই সম্পন্ন করেন এবং সেখানে তিনি সাময়িকভাবে আমাল আন্দোলনে যোগ দেন। পরে তিনি বেলবেকের একটি শিয়া ধর্মীয় সেমিনারিতে পড়াশোনা করেন।
তিনি আমাল স্কুলে পড়িয়েছেন এবং পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইলি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হিজবুল্লাহতে যোগ দেন। মূলত ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সহায়তায় এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব গ্রহণ
১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর তৎকালীন নেতা আব্বাস আল-মুসাভি ইসরাইলি হামলায় নিহত হলে নাসরুল্লাহ মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে একাধিক সফল প্রতিরোধ অভিযান পরিচালনা করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০০ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রত্যাহার। এটি ছিল হিজবুল্লাহর বড় বিজয়, যা নাসরুল্লাহকে লেবাননসহ আরব বিশ্বের মধ্যে একজন প্রতিরোধ নেতায় পরিণত করে।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই
নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ইরান থেকে মিসাইল ও রকেট সংগ্রহ করে, যা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে কাজে লাগানো হয়। ২০০৬ সালে ইসরাইলের সঙ্গে ৩৪ দিনের যুদ্ধে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। যাকে তিনি ‘স্পস্ট বিজয়’ বলে আখ্যা দেন। এ যুদ্ধের পর তিনি আরব বিশ্বের মধ্যে একজন শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
তার নেতৃত্বেই হিজবুল্লাহ দূরপাল্লার রকেট অর্জন করে। যা তাদেরকে উত্তর ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর সক্ষমতা দেয়। যদিও ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে তার দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল।
আঞ্চলিক প্রভাব ও সঙ্ঘাত
হিজবুল্লাহর কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে নাসরুল্লাহ ক্রমেই বিতর্কিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইয়েমেনে হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ততা লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাজতন্ত্রগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। এদিকে ২০১৯ সালে লেবাননের অর্থনৈতিক সংকটে হিজবুল্লাহর ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা দেখা দেয়।
নাসরুল্লাহর সাম্প্রতিক বক্তব্য
নাসরাল্লাহ তার সর্বশেষ বক্তব্যেও ইসরাইলকে দায়ী করেন। কারণ ইসরাইলি বাহিনী হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজার ও রেডিও হ্যান্ডসেটে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এতে ৪২ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। এ ঘটনায় তিনি তা বক্তব্যে বলেন, ইসরাইল ‘সব রেড লাইন অতিক্রম করেছে’।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে সর্বশেষ প্রতিরোধ
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরাইলের হামলা শুরু হলে নাসরুল্লাহ গাজার প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ লেবানন থেকে রকেট ছোঁড়ার নির্দেশ দেন। ইয়েমেন ও ইরাকের প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোও হিজবুল্লাহর সমর্থনে এগিয়ে আসে। তবে ইসরাইলের পালটা হামলায় হিজবুল্লাহর অনেক যোদ্ধা এবং কমান্ডার নিহত হন।
বৈরুতের দাহিয়া উপশহরে হামলা
২৬ সেপ্টেম্বর তেলআবিবের সরকার বৈরুতের দাহিয়া এলাকায় ভারি বিমান হামলা চালায়। এতে কয়েক ডজন মানুষ নিহত এবং বহু সংখ্যক আহত হন। লেবাননে ইসরাইলের সর্বশেষ হামলাগুলো ছিল বেশ তীব্র, যা গত সোমবার থেকে শুরু হয় এবং এতে দেশটিতে ৭ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যাদের মধ্যে হিজবুল্লাহর একজন শীর্ষ কমান্ডার ইবরাহিম আকিলও ছিলেন।
নাসরুল্লাহর মৃত্যু
২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) রাতে ইসরাইলের বোমা হামলায় নাসরুল্লাহ নিহত হন। তার শাহাদাতের ফলে লেবাননজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। কারণ তিনি ৩২ বছর ধরে তার জনগণের পাশে থেকে তাদের আশা ও শক্তি জুগিয়েছিলেন।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, হিজবুল্লাহ কেবল একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং এর নতুন নেতা আরও শক্তিশালী ও তীব্র হতে পারে।
নাসরুল্লাহ তার শোষণমুক্তির সংগ্রামের জন্য চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন। তিনি ইসরাইলকে চ্যালেঞ্জ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সূত্র: আল-জাজিরা ও জিও নিউজ